Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পালাবি তো পালা, জানলা ভেঙে পালা

গোপাল ভাঁড়ের এক গরিব প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ে। তদারকির দায়িত্বে স্বয়ং গোপাল। গোধূলি লগ্নে ঢোল-সানাই বাজিয়ে বর হাজির। মেয়ের বাড়ির উঠোনে বসে বরপক্ষের সানাই যে সুর ধরেছে তাতে কথা বসালে দাঁড়ায়—‘জিতে গেল কানা পুতে।’ অতিথিদের মধ্যে ফিসফাস।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস সৈয়দ
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৪
Share: Save:

গোপাল ভাঁড়ের এক গরিব প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ে। তদারকির দায়িত্বে স্বয়ং গোপাল। গোধূলি লগ্নে ঢোল-সানাই বাজিয়ে বর হাজির। মেয়ের বাড়ির উঠোনে বসে বরপক্ষের সানাই যে সুর ধরেছে তাতে কথা বসালে দাঁড়ায়—‘জিতে গেল কানা পুতে।’ অতিথিদের মধ্যে ফিসফাস। গোপালের মতো বিচক্ষণ লোক থাকতে কি না শেষে সুন্দরী মেয়ের বর কানা! এ কথা কানে গেল গোপালেরও। তিনি শুধু বললেন, ‘‘বিয়েটা হতে দিন। সব বুঝতে পারবেন।” বিয়ে মিটতেই পাত্রপক্ষের সানাই দ্বিগুণ জোরে ধরল, ‘জিতে গেল কানা পুতে।’

এ বার বিয়ের আসরে হাজির কনেপক্ষের সানাই। অপর সানাইবাদকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কনেপক্ষের সানাই ধরল—‘টের পাবে কাল কনে নিতে।’ তার মানে কনে নিশ্চয় খোঁড়া! উত্তেজিত বরকর্তার সে কী হম্বিতম্বি। গোপালের জবাব, “ছেলে কানা এ কথা গোপন করে বিয়ে দিতে এসেছিলেন। এখন মানে মানে খোঁড়া বৌমা নিয়ে ফিরে যান!”

সত্যি মিথ্যে যাই হোক, গোপাল ভাঁড়ের নামে এ চালু গল্পও ধরিয়ে দিচ্ছে বাঙালির বিয়েতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল গান-বাজনা। বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘নৃত্য-গীত-বাদ্যের’ উপস্থিতি বহু যুগ ধরেই চলে আসছে। এক সময়ে বিয়ে উপলক্ষে মুখে মুখে তৈরি গান বা সুরে গাওয়া ছড়া লোকাচারের অঙ্গ হিসেবে প্রায় প্রতি ঘরে পালিত হত। বৈদিক মন্ত্র পড়ে অগ্নিসাক্ষী রেখে বিয়ের যে আনুষ্ঠনিক দিক তার বাইরেও থাকে নানা লৌকিক অনুষ্ঠান। স্ত্রীআচার নামে পরিচিত এই অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্ব গানে গানে ছাওয়া। পাকা দেখা, আশীর্বাদ থেকে শুরু করে বিয়ের দিন সকালে জলসাধা বা জলভরা, গায়ে হলুদ, কনে সাজানো, বাসর যাপন, কড়িখেলা— গোটা বিয়ে জুড়েই থাকত গান। এখনকার বিয়েতে সে সব তেমন ভাবে চোখে পড়ে কই!

তবে মুর্শিদাবাদের মুসলিম বিয়ে এখনও গানের সম্ভারে পূর্ণ। ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ঘিরে অন্দরমহলের খুশি এবং আনন্দের প্রকাশ ঘটে গানের মধ্যে দিয়ে। বিয়ের আনন্দকে জমাট করে তোলার জন্য গানের সঙ্গে ঢোলকের ব্যবহারও রয়েছে। গ্রাম বাংলায় মুসলিম বিয়ের গানগুলিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘গীদ’ বলা হয়। শহরাঞ্চলে ততটা না হলেও গ্রামে এখনও বিয়ের গান গাওয়া হয়। মহিলারা বছরের পর বছর ঠাকুমা, দিদিমার মুখে শুনে শুনেই শেখেন গীদ। বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে গীদের শুরু। ‘কেঁদো না কেঁদো না মেরি কেঁদো না, এ বার কাঁদলে চলে যাবো আইরারে। আইরা থেকে আনবো মাঠের টাইরারে। কেঁদো না কেঁদো না মেরি কেঁদো না। এ বার কাঁদলে চলে যাবো শিলিগুড়ি। সেখান থেকে আনবে হাতের চুড়ি রে।’—এর মতো গান বেশ প্রচলিত। গায়ে হলুদের সময় গাওয়া হয়, ‘কাঁচা হলুদ মাখোরে ছেলে লাল, গায়ের রং হবে সোনা। হলুদ মেখে বর সেজে, পরবে পাজামা।’

গবেষকেরা মনে করেন, বঙ্গভঙ্গের আগে বাঙালি বিয়ের একটা অদ্ভুত মিল ছিল। ভিন্ন ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক সংস্কৃতিটা ছিল একই ধাঁচের। তাই কী হিন্দু কী মুসলমান বিয়ের আসরে গাওয়া হত— ‘সজনের ফুল থোকা থোকা। শিমূল ফুলের আলা রে। ও চিকন কালা, তোর ছোট্ট দিনের বেলা রে। এই সন্ধ্যাবেলা আলি, কালা ভোরবেলাতে পালা রে। পালাবি তো পালা, কালা জানলা ভেঙে পালা রে। সজনের ফুল থেকে শিমূল ফুলের আলা রে।”

তবে আগের মতো না হলেও বিয়েতে আবার ফিরছে অন্দরমহলের গান। (চলবে)

(সহ প্রতিবেদন: অনল আবেদিন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Marriage Music
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE