Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাফল্যের ফর্মুলা পরিশ্রম ও মেধা

মুর্শিদাবাদের রানিনগর সীমান্তের প্রত্যন্ত এলাকার অখ্যাত গ্রাম বাবলাবনার দিন মজুর পরিবারের ছেলে মোশারফ হোসেন এ বারের হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপক। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ থেকে মঙ্গলবার রাজ্যের ১০০ জন মেধাবী পরীক্ষার্থীর যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতে ৭৩৮ নম্বর পাওয়া মোশারফই সম্ভাব্য প্রথম।

জয়ের আনন্দে। বাঁ দিকে, সপরিবার মিনারুল ইসলাম (দ্বিতীয়)। ডান দিকে মোসারফ হোসেন (প্রথম)। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

জয়ের আনন্দে। বাঁ দিকে, সপরিবার মিনারুল ইসলাম (দ্বিতীয়)। ডান দিকে মোসারফ হোসেন (প্রথম)। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।

বিমান হাজরা ও সুজাউদ্দিন
মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০১:৩৫
Share: Save:

মুর্শিদাবাদের রানিনগর সীমান্তের প্রত্যন্ত এলাকার অখ্যাত গ্রাম বাবলাবনার দিন মজুর পরিবারের ছেলে মোশারফ হোসেন এ বারের হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপক। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ থেকে মঙ্গলবার রাজ্যের ১০০ জন মেধাবী পরীক্ষার্থীর যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতে ৭৩৮ নম্বর পাওয়া মোশারফই সম্ভাব্য প্রথম। এক নম্বর কম পেয়ে সম্ভাব্য দ্বিতীয় জঙ্গিপুরের মিনারুল। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই দুই পড়ুয়ার লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শিক্ষকেরা—সকলেই।

মোশারফের পরিবার বিপিএল তালিকাভুক্ত। বাবলাবনা থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘আল আলাম’ মিশনের পড়ুয়া সে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিনা খরচে এই মিশনেই পড়ছে মোশারফ। তার পরিবার সকলেই এক বাক্যে মানছেন সাফল্যেই পিছনে মিশনের অবদান যথেষ্টই। এ দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সকাল ছ’টায় বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে মিশনে যেত মোশারফ। বেলা এগারোটায় ফিরে স্নান-খাওয়ার পরে বেলা একটায় ফের মিশনে। ফিরে এসে ঘরের কিছু কাজ করে ফের পড়তে বসা। মিশনের ডিরেক্টর মহম্মদ মহাবুব মুরশেদের কথায়, পরিশ্রম করার ক্ষমতা আর মেধা—এই দু’য়ের জোরেই পরীক্ষায় সফল হয়েছে মোশারফ। ‘‘মুর্শিদাবাদের বহু এলাকাই পিছিয়ে পড়া। এলাকার উন্নতির স্বার্থে বহু শিক্ষকই এক সময় মিশনে বিনা খরচে পড়িয়েছেন। এখন তার সাফল্য মিলছে। এটাই আনন্দের’’—মত মহাবুব সাহেবের।

১৯৯০ সালে মিশন প্রতিষ্ঠার পরে অনেকটা তাঁর জোরেই এই মিশনের পড়ুয়া সংখ্যা এখন বারোশো ছাড়িয়েছে। দরমার বেড়া হয়েছে তিন তলা। দেড়শোরও বেশি পড়ুয়াকে বিনামূল্যে পড়ানো হয়।

মোশারফের পছন্দের খাবার আলুসেদ্ধ আর ভাত। বিপিএল পরিবার হওয়ার সুবাদে বিনি পয়সায় বিদ্যুৎ মিলেছিল। এক চিলতে ঘরে তক্তপোশের উপরে চলত পড়াশুনো। রাতের বেলায় কারেন্ট চলে গেলে ভরসা কেরোসিনের লম্ফ। পড়া-পাগল ছেলে ও ভাবে পড়তে গিয়ে কোনও দিন বিপদ বাধাবে না তো! সেই আশঙ্কায় পড়া শেষ না হওয়া অবধি চোখের পাতা এক করতে পারতেন না মা তাহেরা বিবি। অভাবের তাড়নায় কলেজের পড়া শেষ করতে পারেননি মোশারফের বাবা গোলাম মোস্তাফা। পাটকাঠি গুণে অভিনব পদ্ধতিতে ছেলেকে অঙ্ক কষতে শিখিয়েছিলেন তিনিই। ছেলের সাফল্যে খুশি বাবা-মা। খুশি প্রতিবেশী মহিদুল ইসলাম, মিজানুর শেখরাও। কাকা আনারুল ইসলামের কথায়, ‘‘ও ভাল ফল করবে জানতাম। কিন্তু, এক্কেবারে প্রথম হবে ভাবিনি।’’ এখন তাঁদের ভাবনা একটাই—এ বার পড়ার খরচ জুটবে কোথা থেকে!

অন্য দিকে, এলাকার মেধাবী ছেলে মিনারুল ইসলাম দ্বিতীয় হওয়ার খবর চাউর হতেই তাঁর বাড়ির সামনে ভিড় জমেছিল। রাজ্যে দ্বিতীয় হয়ে খুশি মিনারুল। মিনারুলের আফশোস, জীবন বিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানে একশোয় একশো না আসায়। তার কথায়, ‘‘যা পরীক্ষা দিয়েছিলাম দুটোতেই একশো পাওয়ার কথা ছিল।’’ বরাবরের কৃতী ছাত্র মিনারুল ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান শাখায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে।

মোশারফের মতো মিনারুলও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে সাফল্যকে ছুঁয়েছে। মিনারুলের বাবা এনামুল শেখ পেশায় হকার, মা মুজিবুন্নেসা বিবি বাড়িতেই সেলাই মেসিনে জামা কাপড় সেলাই করেন। পড়ার ফাঁকে মাকে সাহায্য করে মিনারুল। ছেলের সাফল্যের পিছনে তার বাবা অবশ্য সব কৃতিত্বই দিচ্ছেন স্ত্রীকেই। পাড়ার ছেলে পরীক্ষায় যে অত্যন্ত ভাল ফল করেছে জঙ্গিপুর শহরের জয়রামপুর মণ্ডলপাড়ার বাসিন্দারা এ দিন দুপুরেই তা জেনে যান। দলে দলে এসে খোঁজ করে যান মিনারুলের। বাবা এনামুলের কথায়, ‘‘এত কষ্ট, অভাবের মধ্যেও ছেলে জঙ্গিপুরের মুখ উজ্জ্বল করেছে তা ভেবে ভাল লাগছে।’’

মোশারফ-মিনারুল দু’জনেরই লক্ষ্য চিকিৎসক হওয়া। মিনারুলের এক দাদা ওবাইদুর রহমান ভায়ের সঙ্গেই এ বার পরীক্ষা দিয়েছিল। তার ফল তেমন ভাল হয়নি। নিজের ফল নিয়ে এ দিন হেলদোল ছিল না ওবাইদুরের। তার কথায়, ‘‘আমি পারিনি কিন্তু, ভাই তো পেরেছে। এ রকম ভাই পাওয়া কত গর্বের?’’

বিষ্ণুপুর থানার বকডহরা হাই মাদ্রাসার তিন ছাত্র এ বার রাজ্যের প্রথম দশে নাম তুলে ফেলেছে। রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় আব্দুল মজিদ মণ্ডলের প্রাপ্ত নম্বর ৭৩৪। সম্ভাব্য অষ্টম সৈফুদ্দিন মল্লিক পেয়ে ৭১৯। আর দশম গোলাম নবি খাঁ-র প্রাপ্ত নম্বর ৭১৫। ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মীরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘ওই তিন ছাত্রই দুঃস্থ পরিবার থেকে উঠে এসেছে।’’

মাদ্রাসায় প্রথম দশ

প্রথম: মোশারফ হোসেন—প্রাপ্ত নম্বর (৭৩৮), জেলা: মুর্শিদাবাদ, প্রতিষ্ঠান: আল আলাম মিশন।

দ্বিতীয়: মিনারুল ইসলাম—প্রাপ্ত নম্বর (৭৩৭), জেলা: মুর্শিদাবাদ, প্রতিষ্ঠান: জঙ্গিপুর মনিরিয়া হাই মাদ্রাসা।

তৃতীয়: আব্দুল মজিদ মণ্ডল—প্রাপ্ত নম্বর (৭৩৪), জেলা: বাঁকুড়া, প্রতিষ্ঠান: বোগধারা সিদ্ধিকেয়া হাই মাদ্রাসা।

চতুর্থ: কাজি দিলরুবা খান—প্রাপ্ত নম্বর (৭৩৪), জেলা: জলপাইগুড়ি, প্রতিষ্ঠান: খয়েরবেড়ি হাই মাদ্রাসা।

পঞ্চম: মহম্মদ আলামিন—প্রাপ্ত নম্বর (৭২৯), জেলা: মুর্শিদাবাদ, প্রতিষ্ঠান: আল আলাম মিশন।

ষষ্ঠ: মাসুমা পারভিন—প্রাপ্ত নম্বর (৭২৭), জেলা: উত্তর দিনাজপুর, প্রতিষ্ঠান: রহতপুর হাই মাদ্রাসা।

সপ্তম: মহম্মদ আলমগির আলম—প্রাপ্ত নম্বর (৭২৬), জেলা: মালদহ, প্রতিষ্ঠান: বাতনা হাই মাদ্রাসা।

অষ্টম: সইফুদ্দিন মল্লিক—প্রাপ্ত নম্বর (৭১৯), জেলা: বাঁকুড়া, প্রতিষ্ঠান: বোগধারা সিদ্ধিকেয়া হাই মাদ্রাসা।

নবম: শেখ মুরসালিম আলি—প্রাপ্ত নম্বর (৭১৭), জেলা: পশ্চিম মেদিনীপুর প্রতিষ্ঠান: চাকলাচিপুর এইচ এন হাই মাদ্রাসা।

দশম: গোলাপ নবি খান—প্রাপ্ত নম্বর (৭১৫), বাঁকুড়া, প্রতিষ্ঠান: বোগধারা সিদ্ধিকেয়া হাই মাদ্রাসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE