দড়মার আড়ালেই দিনযাপন। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
গ্রামের মোড়লদের ধার্য করা চাঁদা দিতে না চাওয়ায় তাঁদের একঘরে করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল।
তার পরেও তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় একঘরে করা হয়েছে ভাইয়ের পরিবারকেও।
গ্রামের নলকূপ থেকে জল নেওয়া মানা। স্কুলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্য বন্ধুদের কথা বলা মানা।
ফতোয়া সত্ত্বেও তাঁদের মুখের উপর দরজা বন্ধ না করে দেওয়ায় জরিমানা হয়েছে গ্রামের এক নাপিত, মুদি, চা দোকানির।
শেষমেশ আর সহ্য করতে না পেরে সোমবার বহরমপুর থানায় এই অভিযোগ দায়ের করেছেন রাঙামাটি চাঁদপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের চরমহুলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের দিনমজুর শম্ভু সরকার। সন্ধ্যায় পুলিশ গ্রামে গিয়ে ঘুরেও এসেছে। তবে ধরপাকড় হয়নি।
মুর্শিদাবাদে ভাগীরথীর পাড় ঘেঁষা গ্রাম চরমহুলা দক্ষিণপাড়া। ৮৭টি পরিবারের বাস। তাদের নিয়েই তৈরি ‘চরমহুলা সমাজ’। গ্রামের শিবমন্দিরে ফি বছর দুর্গাপুজো হয়। তার জন্য সাড়ে তিনশো টাকা করে চাঁদা ধার্য হয়েছিল। শম্ভু জানিয়ে দেন, তিনি অত টাকা দিতে পারবেন না।
এতেই মোড়লদের গোসা হয়ে যায়। শম্ভুর অভিযোগ, সালিশি সভা বসিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘সমাজ’ থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হল। গ্রামের কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বা কোনও সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। শম্ভুর ভাই সুশীল সরকার এই ফতোয়া মেনে চলতে পারেননি। তাঁর অভিযোগ, ‘সেই কারণে লক্ষ্মীপুজোর বিসর্জনের দিন থেকে আমাদেরও একঘরে করে রাখা হয়েছে। সমাজে ফিরতে হলে ১০০১ টাকা জরিমানা দিতে হবে। সমাজকে ছাড়তে পারি, নিজের দাদাকে ছাড়ব কী করে?’’
এতেও ক্ষান্ত হননি মোড়লেরা।
গত বুধবার শম্ভুর ভাইপো মিঠুন গ্রামেরই এক নাপিতের কাছে চুল কাটাতে গিয়েছিল। তিনি ফেরাননি। যুগল প্রামাণিক নামে সেই নাপিতকে দেড়শো টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই পরিবারকে মুদির জিনিস দেওয়ায় দেবাশিস সরকারকেও জরিমানা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গ্রামের চা দোকানি অসিত সরকারের আক্ষেপ, ‘‘কয়েক দিন আগে আমার দোকানে এসে চা খেয়েছিল শম্ভু। সমাজের লোকজন খবর পেয়ে জরিমানা বাবদ ১০১ টাকা নিয়েছে।’’
আপাতত অন্য পাড়া থেকে মুদির জিনিস বা খাবার জন নিয়ে আসতে হচ্ছে পরিবার দু’টিকে। ভয়ে পাড়ার তাঁদের সঙ্গে কথা বলে না। সুশীলের স্ত্রী অমিতার অভিযোগ, ‘‘আমার চার আর আট বছরের দুই ছেলে স্কুলে যায়। কিন্তু মাস্টারমশাই ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলা বা খেলা তাদের মানা। বাচ্চাদের মধ্যেও বিষ ঢালছে!’’
সমাজের মোড়ল অশোক সরকার শম্ভুদের ‘একঘরে’ করার কথা আদৌ অস্বীকার করেননি। তবে তাঁর দাবি, ‘‘অনেক সময়ে গ্রামের লোক সমাজ থেকে সুদে টাকা ধার নেন। গত বছর শম্ভু সরকার পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। এ বছর পুজোর আগে তা সুদে–আসলে ৬৬০০ টাকা হয়েছে। তা দিতে রাজি না হওয়ায় একঘরে করা হয়েছে ওদের।’’ শম্ভু অবশ্য টাকা ধার করার কথা মানতে চাননি। রাঙামাটি পঞ্চায়েতের কংগ্রেস সদস্য মুক্তি সরকারের, ‘‘ওদের একঘরে না করলে সমাজ বলে কিছুই তো আর থাকবে না। ওরা ধার্য টাকা মিটিয়ে দিলেই ফতোয়া তুলে নেওয়া হবে।’’
এই মধ্যযুগীয় ফতোয়ার কথা জেনেও পুলিশ-প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে? গ্রামে ঘুরে এসে রাতে বহরমপুর থানার আইসি শৈলেনকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘মঙ্গলবার বিডিও-র সামনে দু’পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসার কথা। আপসে মিটিয়ে নিলে ভাল, না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy