Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশের প্রশ্রয়ে দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য, বলছে বালিয়াডাঙা

তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মুরুটিয়ার বালিয়াডাঙা হাই স্কুল মাঠে ভালই ভিড়। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছেন গ্রামের মহিলারাও। ভ্যান রিকশায় রাখা হয়েছে ব্যাটারি ও মাইক। মাইক্রোফোন হাতে গ্রামের এক যুবক বলে চলেছেন, “এ বড় বিপদের সময়।

বালিয়াডাঙা স্কুল মাঠে গ্রামবাসীদের সভা।

বালিয়াডাঙা স্কুল মাঠে গ্রামবাসীদের সভা।

সুজাউদ্দিন ও কল্লোল প্রামাণিক
মুরুটিয়া শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৩
Share: Save:

তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মুরুটিয়ার বালিয়াডাঙা হাই স্কুল মাঠে ভালই ভিড়। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছেন গ্রামের মহিলারাও। ভ্যান রিকশায় রাখা হয়েছে ব্যাটারি ও মাইক। মাইক্রোফোন হাতে গ্রামের এক যুবক বলে চলেছেন, “এ বড় বিপদের সময়। আজকের পর দুষ্কৃতীরা যে কোনও সময় হামলা করতে পারে। বদলা নিতে পারে পুলিশও। আসুন, সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা একসঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ করি।” খোলা মাঠে ঘণ্টা দেড়েকের ওই মিটিং-এ বালিয়াডাঙা পণ করেছেকিছুতেই তাঁরা আর এমন অন্যায় বরদাস্ত করবেন না।

বুধবার সকালে গ্রামের পুরুষ মহিলা মিলে প্রায় হাজার পাঁচেক বাসিন্দা দল বেঁধে মুরুটিয়া থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। ক্ষিপ্ত জনতা ভাঙচুর করেন পুলিশের গাড়ি, সিসিটিভি, কমপিউটর, জেনারেটর। পুড়িয়ে দেওয়া হয় জেনারেটর রাখার ঘর, লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয় থানার গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও কাগজপত্র। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তো দূরের কথা, উত্তেজিত জনতার ওই রুদ্র মূর্তি ও তাণ্ডবের বহর দেখে থানার ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে পড়েন ওসি-সহ বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মী। দরজার বাইরে তখন রীতিমতো ফঁুসছে জনতা। আর ঘরের ভিতরে ভয়ে কাঁপছে পুলিশ। যা মনে করিয়ে দিয়েছে আলিপুর থানায় ফাইল হাতে টেবিলের তলায় এক পুলিশকর্মীর লুকিয়ে পড়ার দৃশ্য। প্রায় ঘণ্টাখানেক ওই তাণ্ডবের পরে গ্রামে ফিরে যান বাসিন্দারা।

ঘটনার কথা শুনে জনা তিনেক কনস্টেবল সঙ্গে করে মুরুটিয়া থানায় আসছিলেন করিমপুরের সিআই গৌতম ভট্টাচার্য। অভিযোগ, বালিয়াডাঙা বাজারে গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি সিআই ও গাড়ির চালক-সহ মোট পাঁচ জন পুলিশকর্মীকে মারধর করে স্থানীয় বাসিন্দারা। যদিও এমন অভিযোগ মানতে চাননি গ্রামের মানুষ। সিআইকে মারধর ও থানায় ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ দুটো মামলা দায়ের করেছে। তবে লক্ষণীয় ভাবে, অজ্ঞাতপরিচয় গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে ওই দুটি মামলা রুজু করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। পুলিশকে হেনস্থা, মারধর ও থানায় তাণ্ডব চালানোর ঘটনায় পুলিশের যেখানে কড়া পদক্ষেপ করার কথা, সেখানে পুলিশের এই ‘নরম’ মনোভাব প্রমাণ করে দিচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের অভিযোগ অমূলক নয়। সব থেকে বড় কথা যে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষ এতদিন লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন সেই দুষ্কৃতীদের চাঁই জহুর শেখ ও বাবু শেখকে এ দিন সন্ধ্যাতেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গ্রামের বাসিন্দারা সমস্বরে বলছেন, “এই ঘটনাতেই তো স্পষ্ট হয়ে গেল যে পুলিশের প্রশ্রয়েই এতদিন ওই দুষ্কৃতীরা এলাকায় অত্যাচার করছিল। না হলে যারা এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে মুরুটিয়া থানায় গিয়ে ওসি বিমান মৃধার সঙ্গে খোশগল্প করত, এখন সেই পুলিশই তাদের গ্রেফতার করল কী করে?”

ঘটনার পরে মুরুটিয়া থানায় নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ।

গ্রামের একাংশ বলছেন, “হয়তো আইন এ ভাবে হাতে তুলে নেওয়া ঠিক হয়নি। ঠিক হয়নি, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট কিংবা ভাঙচুর করা। কিন্তু এটাও সত্যি এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনও বিকল্প পথ খোলা ছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের এক বাসিন্দার কথায়, “আজ বছর দেড়েক ধরে দুষ্কৃতীদের এই অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। অথচ ওদের কিছু বলার উপায় ছিল না। কথায় কথায় আগ্নেয়াস্ত্র বের করে খুনের হুমকি দিত। বলত, তেমন হলে স্কুল থেকেও ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে যাবে। লিখিত ও মৌখিকভাবে কমপক্ষে পনেরো বার অভিযোগ জানিয়েও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেনি। উল্টে অভিযোগকারীকেই নানা ভাবে হেনস্থা করা হত।” কিন্তু যে পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে গোটা গ্রামের অভিযোগ, সেই ওসি বিমান মৃধা বলছেন, “যা বলার বড় সাহেব বলবেন। আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।” আর বড়সাহেব তথা নদিয়ার পুলিশ সুপার সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “এই ঘটনায় যদি পুলিশের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে সেই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”

তবে গ্রামবাসীরা অবশ্য সে কথায় ভরসা পাচ্ছেন না। স্থানীয় এক প্রৌঢ়ের কথায়, “শুনেছি পুলিশ ছাইয়েরও দড়ি পাকাতে পারে। মুখে যাই বলুক না কেন, সুযোগ পেলেই গ্রামের লোককে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে ওদের সময় লাগবে না। তাছাড়া এ দিন তো মাত্র দু’জনকে ধরেছে। বাকিরা তো এখনও অধরা। তারা যে আচমকা কোনও কিছু করে বসবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?”

সীমান্তঘেঁষা এই গ্রাম একটা সময় ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের অত্যাচারে। তখনও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া হয়নি। খুন, ডাকাতি ছিল সীমান্তের রোজনামচা। বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ বলছেন, “সীমান্ত সুরক্ষিত হওয়ার পরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ভেবেছিলাম, আর বোধহয় অশান্তি হবে না। কিন্তু এখন বুঝছি, দুষ্কৃতীদের আলাদা কোনও দেশ হয় না। তারা সর্বত্রই রয়েছে। তবে আক্ষেপ একটাই, যে পুলিশের কথা ছিল গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানো, তা না করে পুলিশ পক্ষ নিল দুষ্কৃতীদের। পুলিশ যদি ন্যূনতম সক্রিয় হত তাহলে এ দিনের এই ঘটনা এড়ানো যেত।”

ওই বৃদ্ধের কথাটা যে কথার কথা নয়, তা টের পাওয়া যায় বালিয়াডাঙার অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেও। স্থানীয় এক অভিভাবক বলছেন, “আমার সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দিনকয়েক আগে বলছিল যে, সে আর একা স্কুলে যাবে না। তার ভয় কেউ যদি তাকে তুলে নিয়ে যায় কিংবা মেরে ফেলে! ভাবুন একবার, ওই দুষ্কৃতীদের আতঙ্কটা কোন পর্যায়ে গিয়েছে।” স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলছেন, “ওদের দৌরাত্ম্যে ব্যবসাই শিকেয় উঠেছে। যে কোনও সময় দোকানে ঢুকে খাবার খেয়ে পয়সা তো দিতই না, উল্টে ভয় দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে যেত।” গ্রামবাসীদের কথায়, “এ ছাড়াও জমি দখল করে জমির মালিকের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায়, সরকারি গাছ কেটে বিক্রি করা, বিভিন্ন কায়দায় তোলাবাজিএ সবই রোজনামচা হয়ে গিয়েছিল ওই দুষ্কৃতীদের।” বালিয়াডাঙা হাই স্কুলের এক শিক্ষকের কথায়, “এ দিনের ঘটনায় স্কুলেও পড়ুয়াদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো কম। এক পিরিয়ড পরেই স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল।”

এই ঘটনায় স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন। সিপিএমের করিমপুরের জোনাল কমিটির সম্পাদক অজয় বিশ্বাস বলেন, “মুরুটিয়া থানায় এই জনরোষ দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।” করিমপুর ২ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আফাজউদ্দিন বিশ্বাস বলেন, “পুলিশের উচিত ছিল দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশ যদি দুষ্কৃতীদের পক্ষ নিলে মানুষ যাবেন কোথায়?”

করিমপুর ২ ব্লকের বিজেপির পর্যবেক্ষক অজিতা রায় বলেন, “চারদিকে যা ঘটছে এরপরেও পুলিশ যদি শিক্ষা না নেয় তাহলে কিছু বলার নেই। পুলিশ কি তার আত্মসম্মানটুকুও হারিয়ে ফেলেছে?” তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলছেন, “দুষ্কৃতীদের ইতিমধেই পুলিশ গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। তবে থানায় চড়াও হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনারও আমরা নিন্দা করছি।”

বিশ্বজিত্‌ রাউত ও কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।

(সহ প্রতিবেদন: সুস্মিত হালদার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE