Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাংসদ নেই, উন্নয়নের পথ খুঁজছে কৃষ্ণনগর

সাংসদ নেই। কবে ফিরবেন, জানে না কৃষ্ণনগর। বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট সিআইডি তদন্ত নিয়ে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার পর কৃষ্ণনগরে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি এখন এলাকায় আসবেন না তাপস পাল? দল অবশ্য আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে তাঁকে। দলের বক্তব্য, তিনি অসুস্থ। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “তাপস পাল অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।

তখন তাপস। কৃষ্ণনগরে লোকসভা ভোটের প্রচারে।—ফাইল চিত্র।

তখন তাপস। কৃষ্ণনগরে লোকসভা ভোটের প্রচারে।—ফাইল চিত্র।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪৪
Share: Save:

সাংসদ নেই। কবে ফিরবেন, জানে না কৃষ্ণনগর।

বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট সিআইডি তদন্ত নিয়ে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার পর কৃষ্ণনগরে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি এখন এলাকায় আসবেন না তাপস পাল?

দল অবশ্য আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে তাঁকে। দলের বক্তব্য, তিনি অসুস্থ। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “তাপস পাল অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেই কৃষ্ণনগরে এসে আবার মানুষের জন্য কাজ করবেন।” তাঁর দাবি, এলাকায় সাংসদের কাজ সাংগঠনিক ভাবে সামলে দেওয়া হচ্ছে, কোনও সমস্যা হচ্ছে না।

বাসিন্দাদের একাংশ অবশ্য বলছেন অন্য কথা। চৌমাহা গ্রামে তাপস পালের ‘রেপ করিয়ে দেব’ হুমকি সংবাদমাধ্যমে আসার পরেই ভয়ে-লজ্জায় নদিয়া ছেড়েছেন সাংসদ। কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কাছে উনি তো ফেরার।” তাঁর প্রশ্ন, দ্বিজেন্দ্রলালের জন্মভিটেতে একটা প্রেক্ষাগৃহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাপস। সেই কাজ আদৌ হবে কি? কুঠিরপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পলাশ বিশ্বাস বলেন, “এক জন জনপ্রতিনিধি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় দিনের পর দিন না থাকলে উন্নয়ন ব্যহত হতে বাধ্য।” তাঁর ক্ষোভ, ছাত্রছাত্রীদের ভাতা পেতে সাংসদ, বিধায়কের সই দরকার হয়। তাদের অসুবিধে হচ্ছে।

অসুবিধের কথা অবশ্য স্বীকার করছে না দল। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সাংসদের সই-করা শংসাপত্র পেতে যাতে সাধারণ মানুষকে হয়রান হতে না হয়, তার জন্য দলগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাপসবাবুর বাড়ি থেকে কাগজপত্র সই করিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। জেলা কার্যালয় থেকে কিছু কিছু করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্লক কার্যালয়ে। দলের নেতাদের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করছেন আবেদনকারীরা।

কিন্তু তাপসবাবুকে ছাড়া সাংসদ তহবিলের টাকায় উন্নয়ন হবে কীভাবে? সেক্ষেত্রেও দলের তরফে একটা সমাধানের রাস্তা বের করা হয়েছে। নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ বলেন, “ঠিক হয়েছে, এলাকার বিধায়কদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে জেলা নেতৃত্ব গুরুত্ব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাজের একটা তালিকা তৈরি করবেন। সেই তালিকা পৌঁছে দেওয়া হবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাতে। তাঁর অনুমোদনের পরে তাতে সই করানো হবে সাংসদকে দিয়ে।

কিন্তু প্রশাসনিক তত্‌পরতা দেখিয়ে রাজনৈতিক ধাক্কা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁর ‘কুকথা’ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরে দেশ জুড়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দলের অভ্যন্তরে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই দলে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন তাঁর অনুগামীরাও। তার উপরে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য সামনে আসার পর থেকে তিনি আর কৃষ্ণনগরে আসেননি। এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে বিভিন্ন ব্লকে তাঁর অনুগামীদের সংগঠনও ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। অনেকে নাম লিখিয়েছেন দলেরই তাপস-বিরোধী গোষ্ঠীতে।

দলের একটি অংশের দাবি, গত লোকসভা ভোটের পরে তাপসবাবু তার লোকসভা এলাকায় বিভিন্ন ব্লকে বিধায়কদের সমান্তরাল ‘নিজস্ব’ গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। প্রথম দিনের প্রচারে দেখা মেলেনি বিধায়কদের। তাঁর এই দুর্দিনে সাংগঠনিক ভাবে সেই সব বিধায়করা সব‌ চাইতে বেশি লাভবান হয়েছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তবে ‘দাদার কীর্তি’র জন্য সব বিধায়ক যে লাভবান হয়েছেন তাও নয়। বিশেষ করে যে সব বিধানসভা এলাকায় তাপসবাবু ‘কুকথা’ বলেছিলেন সেই এলাকায় তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি অনেকটাই সরে গিয়েছে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করে নিচ্ছেন স্থানীয় নেতৃত্ব। বিশেষ করে যে ভাবে আদালতে প্রতিদিন সাংসদের বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে জনমানসে একটা প্রভাব পড়ছে বলেই মনে করছেন দলের অনেকেই। তাপস পালের বক্তৃতার জন্য রাতারাতি পরিচিত হয়ে উঠেছিল নাকাশিপাড়া বিধানসভা এলাকার চৌমাহা গ্রাম। ঘটনা প্রচার হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক কল্লোল খাঁ তাপস পালের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। এ দিনও তিনি বলেন, “আদালতে বিষয়টি নিয়ে বিচার চলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তার একটা প্রভাব তো পড়বেই।”

তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে যতটা না প্রভাব পড়েছে তার‌ থেকেও বেশি প্রভাব পড়েছে অনুগামীদের মধ্যে। চাপড়া এলাকায় তাপস-অনুগামী বলে পরিচিত এক তৃণমূল নেতা বলেন, “এতদিন দাদার জোরে বুক ফুলিয়ে দল করেছি, এখন দাদার কঠিন অবস্থা। সক্রিয় ভাবে দল করতে হলে অন্যের কাছে নত হয়ে করতে হবে। সেটা পারব না। তাই বসে গিয়েছি।” ওই নেতার বিশ্বাস কঠিন সময় কাটিয়ে তাপস ফের স্বমহিমায় ফিরে আসবেন। লোকসভা ভোটের আগেই নির্বাচনী প্রচারে তাপসবাবুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এক আইনজীবী। প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, “আমি আর ওসবের মধ্যে নেই। এখন শুধু মন দিয়ে কাজটাই করতে চাই।” তাপসবাবুর অনুগামী না হলেও কৃষ্ণনগরে দলের এক কর্মী লোকসভা ভোটে উত্‌সাহ নিয়েই প্রচার করে ছিলেন। বিজয় উত্‌সবেও তাঁকে দেখা গিয়েছিল সামনের সারিতে। তিনি বলেন, “তেমন হলে রাজনীতি ছেড়ে দেব, কিন্তু তাপস পালের সঙ্গে আর না।” নদিয়া জেলা নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের দাবি, তাপসবাবু সরাসরি রাজনীতির লোক না হওয়ায় সাংগঠনিক ভাবে তেমন কো‌নও প্রভাব পড়েনি।

কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? প্রশ্নটা নেতাদের কাছে প্রায়ই করছেন দলের সাধারণ কর্মীরা। কর্মীদের উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করার মানে বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন জেলা নেতৃত্ব। তার কেন্দ্রের একাধিক গ্রামে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে একের পর এক উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছিলেন তাপস পাল। দলের ছেলেদের ঢুকিয়ে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন, বিরোধীদের ঘর ভাঙার নির্দেশও দিয়েছেন। তার জেরে বিরোধীদের আক্রমণের মুখে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তৃণমূল নেতৃত্ব। বাধ্য হয়েই তাকিয়ে রয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE