২০০৬ সালে কান্দির সিপিআই প্রার্থী চন্দন সেনের সমর্থনে ঋত্বিকের পথনাটিকা ‘কঙ্কাল’।— ফাইল চিত্র
নিজের শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে কেউ হতেন বফর্স কামান। কেউ বা সেই কামানের হাতল। তার পর খোলা আকাশের নীচে ‘বোফর্স কেলেঙ্কারি’রা ভাসিয়ে দিতেন তাঁরা।
নাটকের নাম ‘কে লিলোরে টাকাটা’। ভোটের বাজারে এমন নাটক দেখে যাঁরা কিছুই জানেন না, কাঁটা দিয়ে উঠত তাঁদের গায়েও। বহরমপুর থেকে পদ্মাপাড়ের প্রত্যন্ত কাদামাটির জলঙ্গির গাঁ— যে দলকেই ভোট দিক না কেন, এমন নাটক দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ত। এবং বছর পাঁচেক আগেও সে ভি়ড় কম হত না।
বাম ঘেঁষা নাটকের দলগুলির ভোট প্রচারের সেই সাবেক কৌশল রাতারাতি তলানিতে। ২০১১ সালে বিধানসভার ভোটের বাজারেও দু’একটি দল পথনাটক করে নিজেদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ রেখেছে। এ বার ভোটে সেই দায়টুকুও উধাও। এ বার ভোট প্রচারে নেই বহরমপুরের কোনও নাট্যদল। পথে প্রচারে না থাকলেও স্মৃতির সরণিতে আছেন সেই সব পালা সামাল দেওয়া লবকুশেদের গলায় এখন গাঢ় দীর্ঘশ্বাস— সেই নাটকগুলো বোধহয় স্মৃতি হয়ে গেল।
সুন্দরবনে ‘বাঞ্ছা আবার ফিরে এল’ সিনেমার প্রধান চরিত্রের শ্যুটিং-এ ব্যস্ত ‘বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটর’-এর প্রদীপ ভট্টাচার্য শ্যুটিং-এর ফাঁকে ফোনে জানাচ্ছেন, জরুরি অবস্থার অবসান হয়েছে। ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়েছে। তখন তিনি বহরমপুরের ‘প্রান্তিক’ নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে। জরুরি অবস্থা নিয়ে দিব্যেশ লাহিড়ির লেখা ‘নানা হে’ নাটকটা করেছিলেন অঞ্জন বিশ্বাস। রাজ্য জুড়ে ভোট প্রচার করছেন। সব জেলা থেকে আমন্ত্রণবলছেন, ‘‘সে এক হইহই ব্যাপার।’’ ১৯৯৬ সাল, একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার সাধারণ নির্বাচন। বহরমপুর লোকসভা আসনে ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী সদ্য প্রাক্তন পঞ্জাবের রাজ্যপাল, তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শঙ্করদাস পাল। বাম মহলে জোর প্রচার— শঙ্করদাসের পরামর্শেই ইন্দিরা গাঁধী ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছিলেন। ফের সিপিএমের ‘ভিয়েতনাম’ নবগ্রামে বিধানসভায় কংগ্রেসের ‘রবিনহুড’ প্রার্থী খুনের মামলায় ফেরার অধীর চৌধুরী। এই সময়ে ডাক পড়েছিল নাটকের দলগুলির। ততদিনে ‘প্রান্তিক’ থেকে সরে এসে নিজের নাট্যদল ‘বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার’ (বিআরটি) গড়েছেন প্রদীপ। তিনি বলেন, ‘‘জরুরি অবস্থাকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছিল ভোট প্রচারের পথনাটক। ইয়েলো জার্নালিজম নিয়ে লেখা হয়েছিল নাটক ‘নো এন্ট্রি’।’’ এ বার দিদির জমানায় সে সব নিয়ে অবশ্য তেমন জোরদার কোনও নাটক হয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না হালের নাট্যকারেরা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘কী করে হবে বলুন তো? সামান্য ফেসবুকে একটা রসিকতাই যাঁরা নিতে পারেন না, তাঁরা নাটকের শ্লেষ সইবেন, মনে হয় না।’’
২০০৬ সালে কান্দি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই-এর হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন কলকাতার নাট্যদল ‘হযবরল’- এর খোদ কর্ণধার চন্দন সেন। ডাক পড়ল বহরমপুরের সব নাট্যদলের। ‘ঋত্বিক’ নাট্যসংস্থার সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী বলেন, ‘‘তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কান্দিতে নাটক করেছি। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমরা টানা ভোটের নাটক করেছি।’’ চন্দন সেনের ডাকে অবশ্য সাড়া দেননি বহরমপুরের দু’টি নাট্যগোষ্ঠী— ‘যুগাগ্নি’ ও ‘ব্রীহি’। অথচ এই দু’টি দলকেই পথনাটকের দল বলে বহরমপুরের মানুষ জানে। ‘ব্রীহি’র দীপক বিশ্বাস ও ‘যুগাগ্নি’র দেবাশিস সান্যাল বলছেন, ‘‘আমরা বরাবর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও লিঙ্গ বৈষম্য সংক্রান্ত বিষয় ভিত্তিক নাটক খোলা আকাশের নীচে আমজনতার সামনে করে থাকলে চন্দন সেনের ডাকে সাড়া দিইনি। কারণ আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে, বা বিপক্ষে নই।’’
ওই দু’টি দল বাদে শহরের প্রায় সব দলই ভোটের প্রচারে নাট্যসম্ভার নিয়ে সামিল হয়। ছোটদের নাট্যসংস্থা ‘যুবনাশ্ব’র দুলাল দত্ত বলেন, ‘‘গণনাট্য সঙ্ঘ ছাড়াও বহরমপুরের ঋত্বিক, রের্পটরি, প্রান্তিক, উজান, সুহৃদ-সহ বিভিন্ন দল প্রচারে পথনাটক নিয়ে সামিল হত।’’ এখন হয় না? উত্তর মেলেনি।
সেই ট্রাডিশনে ছেদ পড়েছে কেন? ঋত্বিকের মোহিতবন্ধু বলেন, ‘‘নাট্যদলের অনেকেই সরকারি কর্মী। কে কী মনে করে কী শাস্তি দেবে কে জানে!’ তাঁর অভিমান, ‘‘অতীতে রাজনৈতিক দলগুলি নাট্যদলগুলিকে কদর করে ডাকত। তেলেভাজা মুড়ি খাওয়াত। গ্রামে গ্রামে নাটক করার জন্য গাড়ি দিত। এখন তো ডাকেই না!’’ দুলাল বলছেন, ‘‘১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় চলে আসার পর গণ আন্দোলনের অভিমুখের পরিবর্তন ঘটল। নন্দীগ্রাম-সিঙুর নিয়ে নাট্যকর্মীরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। প্রভাব পড়ল ভোটের নাটকে।’’
তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বাবা বিষ্ণু বসু গণনাট্য সঙ্ঘের হাল ধরে থাকলেও ছেলে ব্রাত্য বসু তৃণমূলে। আবার, ‘‘মা চিত্রা সেন আজও বামফ্রন্টের সঙ্গে থাকলেও ছেলে কৌশিক সেন এখন বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের কড়া সমালোচক।’’
ডান-বামে কেউ আর নাটকে নেই, ভোটের ময়দান থেকে তাই উইংসে মুখ ঢেকেছে পথ নাটকের সেই সব সন্ধ্যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy