দেওয়ালির দিন তিনতলা বাড়ির সব আলোয় ঝলমল করছিল, অন্ধকার ছিল শুধু ফর্সা মুখটায়। বিকেল থেকে সময় লাফিয়ে লাফিয়ে গভীর রাতে পৌঁছে গিয়েছে। ছাদের রেলিঙের উপর জমাট বেঁধে রয়েছে গলে যাওয়া মোমের অবশিষ্ট। রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ষোলো বছরের ছেলেটি। চার মাস হয়ে গিয়েছে হোমে সকলের সঙ্গে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। সহ-আবাসিকরা আলো জ্বেলে দিলে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডরের শেষ দিকটায় চলে যায়। ওখানে অন্ধকার থাকে সারা বছর। ছেলেটির নাম কমল দেবনাথ। অসমের বাসিন্দা। একা একা উঠে পড়েছিল দূরপাল্লার ট্রেনে। পুলিশ নামিয়ে হোমে পাঠিয়ে দিয়েছে। কারও সঙ্গে কথা নেই, কেউ আদর করতে এলে সরে যেত ছেলেটি। হোমে আসার পর চার দিন কিছু মুখে তোলেনি। বন্ধুও ছিল না কমলের।
দিনহাটার গণেশ রায়ের মা-বাবা কেউ নেই। ছোটবেলার খুব চেনা সম্পর্ককে রাতারাতি বদলে যেতে দেখেছিল চোদ্দো বছরের ছেলেটি। বদলে যাওয়া সম্পর্ক বাড়ি ছেড়ে পথে নামিয়েছিল তাকে। হোমে এসেও স্বাভাবিক হতে পারেনি। আর ছেলের দল যখন মাঠে ফুটবল খেলত, গণেশ মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। কখনও দু’একটা ঘাস ছিঁড়ত। গভীর রাতে বিছানায় উঠে বসে থাকত। টের পেয়ে কোনও সহ-আবাসিক কিছু জিজ্ঞেস করলে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত গণেশ। কল দিয়ে জল পড়তে থাকার শব্দে হয়তো চাপা পড়ে যেত কান্নার স্বর।
তবু এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
জলপাইগুড়ির সরকারি কোরক হোমের সামনে পেল্লায় সবুজ মাঠ। অনাথ, ভবঘুরে শিশু-কিশোরদের থাকার সরকারি হোমের মাঠে আবাসিকরা সকাল-বিকেলে খেলায় মত্ত থাকে। হোমে আসার পর কত মাস কেটে গিয়েছে মাঠে পা পড়েনি গণেশের। প্রথম যেদিন সেই মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটল কমল, চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি হোমের সুপার দেবব্রত দেবনাথও। এখনও সেই দিনটির কথা মনে করতে পারেন তিনি। বললেন, “পায়ে বল নিয়ে কমলের দৌড় দেখে মনে হয়েছিল, ম্যাচটা যেন আমিই জিতেছি! ভীষণ অবসাদগ্রস্ত এক কিশোর, যার চুল থেকে নখ পর্যন্ত অন্ধকারে ঢাকা বলে মনে হত। তাকে খেলার মাঠে আনতে পারাটাই আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল!”
কোরক হোমে যে আবাসিকেরা থাকতে আসে, তাদের চলাটা আর পাঁচটা শিশুর মতো সহজ সরল নয়। অসংখ্যবার বুক ভেঙে যাওয়া, দোমড়ানো-মোচড়ানো আত্মবিশ্বাস নিয়েই হোমের বড় গেট ঠেলে ঢুকতে হয়। সেই হোমেরই দুই চূড়ান্ত অবসাদগ্রস্ত আবাসিক এ বছরের রং খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের ঘিরেই মেতে উঠবে গোটা হোম বসন্তোৎসবে। হোম সুপার বললেন, “কমল এবং গণেশ দু’জন এ বছরই প্রথম রং খেলবে! আশা করি, রঙের এই উৎসবের আমেজ-আনন্দ ওদের মনকে স্পর্শ করবে’ ওরা যাতে রঙের সঙ্গে আরও বেশি করে নিজেদের মনকে মাখিয়ে দিতে পারে, তার জন্য বসে আঁকো প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছে।” রং খেলার আগের দিন বসে-আঁকো প্রতিযোগিতা। সকলের হাতে ড্রইং শিট আর রঙের প্যাকেট। আবাসিকেরা ইচ্ছেমতো রঙে ভরিয়ে তুলছে সাদা কাগজ! অনুপম সেই ছবি! কিন্তু কী ভাবে অন্ধকারের বাইরে নিয়ে আসা গেল দুই কিশোরকে?
অসমের বাসিন্দা কমল কয়েকমাস একটাও কথা বলেনি। এক সহ-আবাসিকের কথায়, ”আমাদের মনে হত, চিমটি কাঁটলেও বোধ হয় রা কাড়বে না। চোখ দু’টো সবসময় যেন বুজে যেতে চাইছে।” হোমে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গানের ক্লাস ইত্যাদি হয়। কোনও কিছুতেই তাদের দেখা যেত না। হোমের কাউন্সিলরেরা কথা বলার চেষ্টা শুরু করেন তাদের সঙ্গে। প্রথম দিকটায় ওরা শুধুই শুনত। ধীরে ধীরে উত্তর দিতেও শুরু করে। এখন হোমের প্রতিদিনের কাজ, যেমন জামা-কাপড় ধোওয়া, হোম পরিচ্ছন্ন রাখা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব বণ্টনের ভার কমলের হাতে। সেই ঠিক করে দেয়, কে কী করবে। যে এক সময়ে কারও সঙ্গে কথাই বলত না, সেই এখন সকলকে নিয়ে চলার দায়িত্বে। আর গণেশ এখন ফুটবল-অন্ত প্রাণ। মাঠের দিকে তাকিয়ে ঘাস ছিঁড়তে থাকা সেই কিশোর ফুটবল পায়ে এখন তির গতিতে ছোটে। কে কী ভাবে খেলল, খেলার পরে তার বর্ণনা খইয়ের মতো ফুটতে থাকে গণেশের মুখে।
এ বারের দোলে, বসন্তের উৎসবের রং খেলায় সকলের সঙ্গে ওরাও আবির মাখবে। রং লাগবে ওদের চুলে, গলায়, কানে, মুখে! ঘাত-প্রতিঘাতে ক্লান্ত জীবন নতুন আশায় রঞ্জিত হয়ে উঠবে নতুন ছন্দে!
বসন্ত-মাহাত্ম্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy