Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আমিও নীল তিমি, জাহিরই নয়া ট্রেন্ড

কোন সেই সুদূর রাশিয়ায় তৈরি একটি আত্মঘাতী খেলা, তার জাল কী ভাবে যেন ছড়িয়ে যায় বাংলার মফস্সলে। ধাপে ধাপে তৈরি করে আত্মহননের পথ। কারও বেলায় সত্যি, কারও বেলায় হয়তো বা গল্পে।

মারণ-খেলা: ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে এ ভাবেই আঁকতে হয় ছবি।

মারণ-খেলা: ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে এ ভাবেই আঁকতে হয় ছবি।

সোহিনী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:০৬
Share: Save:

হলদে পাখির পালক, জাদুকরি মাঞ্জা, সবুজ কাচ, নিদুলি মন্ত্র, পক্ষীরাজ— রাত জেগে অন্ধকার বন্ধঘরে গোগ্রাসে একটার পর একটা ‘লেভেল’ পার করে চলে রুমু আর বোগি। সব ‘লেভেলে’ই হারানোর গল্প। রুমুর চোখ ঠেলে জল আসে। বোগি বই পড়ে। কিন্তু ঝগড়ুর মুখে শোনা দুমকার আশ্চর্য অলীক রোমাঞ্চকর সেই গল্পের নেশা কেউই এড়াতে পারে না। কারণ, সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, আর স্বপ্নের কোথায় শুরু— তার খোঁজ চিরদিনই কৈশোরকে তাড়িয়ে বেড়ায়!

লীলা মজুমদারের ‘হলদে পাখির পালক’-ই যেন অন্য চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে এখন। না হলে সন্ধের পরে কেন অন্ধকারে রাতভর মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকবে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রটি! নাছোড় বায়নায় ছাগল বেচে তাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলেন পেশায় কৃষক বাবা। ক’দিন আগে হঠাৎই খেয়াল করেন ছেলের হাতে মাছের আদলে কাটা দাগ। ছেলে জানায়, আড়াই মাস ধরে ‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলছে। তার পঞ্চম ‘লেভেল’ এটি। তার পর থানা-পুলিশ-মিডিয়াজলঙ্গির এক ছাত্র খাটেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তার দাবি, সে ছিল ৩২ নম্বর ধাপে!

কোন সেই সুদূর রাশিয়ায় তৈরি একটি আত্মঘাতী খেলা, তার জাল কী ভাবে যেন ছড়িয়ে যায় বাংলার মফস্সলে। ধাপে ধাপে তৈরি করে আত্মহননের পথ। কারও বেলায় সত্যি, কারও বেলায় হয়তো বা গল্পে।

যেমন, জলপাইগুড়ির ফণীন্দ্রদেব ইনস্টিটিউশনের দুই ছাত্র বা গড়ালবাড়ির স্কুলের ছাত্রটি স্রেফ বন্ধুদের দেওয়া চ্যালেঞ্জ নিয়েই হাত কেটে ফেলে। পুনরাবৃত্তি শিলিগুড়ি, কালিয়াগঞ্জ, নাগরাকাটাতেও। এদের অনেকের স্মার্টফোনই নেই, জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা।

যে একাকিত্ব থেকে আত্মহননের খেলায় মাতছে রাশিয়ার কিশোরেরা, তেমন একা এই ছেলেরা নয়, বলছিলেন ফণীন্দ্রদেব ইন্সটিটিউশনের প্রধানশিক্ষক অভিজিৎ গুহ। উত্তরবঙ্গের এই স্কুলগুলির বেশির ভাগ প্রধানশিক্ষকেরই মত, এরা পড়াশোনায় প্রায় সকলেই মধ্যমানের, বেশির ভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। ফলে এদের না-পাওয়া অনেক বেশি, তেমনই বেশি ইচ্ছেপূরণের চাহিদাও। ট্রেন্ডে মিশতে চেয়ে, দলে ভিড়তে চেয়ে তাই ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি আসলে তাদের বিচ্ছিন্নতার দিকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কিশোর মন হট্টগোলের মধ্যেও একাকী পরিসর তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। তার উপরে স্মার্টফোনের ব্যক্তিগত পরিসরকে ঘেরাটোপের মধ্যে নিয়ে আসে। তা সে একান্নবর্তীই হোক বা নিউক্লিয়ার পরিবার। ‘হলদে পাখির পালকে’ কিন্তু কল্পনার জগতের নেশা কিশোর রুমু-বোগিকে চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যায়নি। বরং বোগিদাদা বুঝিয়েছিল, বুকের ফাঁকা জায়গাটা ভরাতে বেরিয়ে পড়তে হয়।

ভার্চুয়াল খেলায় এই ‘বেরিয়ে পড়া’টাই নেই। যেনতেনপ্রকারেণ বন্ধুদের কাছে সমীহ আদায় করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোযোগ পাওয়ার উপরেই তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে যেন। এই ভার্চুয়াল নির্ভরতাই ক্রমশ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে আজকের কিশোরদের। এই সমান্তরাল জগতে ছেলেদের যোগদান আবার বেশি। মনোচিকিৎসক প্রশান্ত রায়ের ব্যাখ্যা, “মেয়েদের অনেক বেশি সামাজিক মেলামেশার যোগ্য করে বড় করা হয়। তারা আবেগ-অনুভূতির কথাও অনেক বেশি বন্ধুদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ছেলেরাও বন্ধুদের সঙ্গে মেশে। কিন্তু তাদের শেখানো হয়, আবেগ ঢেকে রাখার মধ্যেই পৌরুষ। ফলে তাদের একাকিত্ব বেশি।” তাই ছেলেরা যখন নানা ঘরবন্দি, ধ্বংসাত্মক খেলায় মাতছে, মেয়েরা মাতছে নিজস্বীর নেশায়। প্রশান্তবাবু জানান, মেয়েদের মধ্যে হাত কাটার প্রবণতা বেশি বলে ব্লু হোয়েলে তাদেরও কিছু আগ্রহ চোখে পড়ছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে সব প্রেমের সম্পর্কের টানাপড়েনের জেরে করছে।

পুজো মিলনের উৎসব। তার মধ্যেও মোবাইল হাতে টুকরো টুকরো দেওয়াল গড়ে, তার মধ্যে বসবাস করবে এখনকার প্রজন্ম। তাদের বন্ধু হয়ে ‘বেরিয়ে পড়া’ শেখানোর দায়িত্ব মা-বাবারই। সেটার সুযোগ দেয় দুর্গাপুজোই, বলছেন মনোবিদেরা।

মা-বাবারা শুনতে পাচ্ছেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE