রাতে জঙ্গলের ভিতরে আলো দেখে এগোবেন ভেবেছেন? সাবধান! দু’পা গেলেই গায়ে ঢিল পড়তে পারে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বনাঞ্চল সম্পর্কে এমন সর্তকবার্তা শোনা যায় আকছার।
আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশীর একফালি চাঁদ আকাশে। গয়েরকাটা শহরের ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা চলে গিয়েছে নাথুয়ার দিকে। রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই মরাঘাটের জঙ্গল। অন্ধকার রাতে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্থির আলো। বড় এলইডি টর্চের। সাদা চকচকে আলোর উৎসের খোঁজে সামনে এগোতেই রাস্তায় আছড়ে পড়ল একটা পাথর। আরও কয়েক পা এগোতেই পটাপট উড়ে আসতে থাকল ঢিল। আগুন্তুককে সর্তক করতেই ‘জঙ্গলের বার্তা’।
স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, “আরও কয়েক পা এগোলে ঢিলের বদলে তির ধেয়ে আসতে পারে, অথবা ছররা গুলি।” গভীর রাতে জঙ্গলের ভিতর থেকে ইঞ্জিন লাগানো ভ্যান তথা ভুটভুটি বের হওয়ার শব্দ শোনেন বাসিন্দারা। ভুটভুটিতে নিয়ে যাওয়া হয় রাতভর কাটা গাছের গুড়ি।
এমন কথা বনকর্তাদের কারও অজানা নয়। জানে প্রশাসনের শীর্ষ মহলও। গত সপ্তাহে উত্তরকন্যায় জলপাইগুড়ি জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বণিকসভার প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, চা বাগানে বিদ্যুতের তার নিয়ে যেতে খুঁটি বসাতে বাধা দিচ্ছে বন দফতর। যা শুনে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, “ফরেস্টের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, শুধু বাধা দেয়। নিজেরা কাঠচুরি করে খাবে, জঙ্গলের ভিতর কাউকে ঢুকতে দেবে না।” মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যে বন দফতরের অন্দরে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে।
তারপরেও যে পরিস্থিতি বদলায়নি, তার প্রমাণ মরাঘাটের জঙ্গল থেকে কাঠামবাড়ি, ওদলাবাড়ি, বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় সন্ধ্যের পরে আলো জ্বলতে থাকে।
বনমন্ত্রী বিনয় বর্মনের দাবি, “কাঠচুরি ঠেকাতে বনকর্মীদের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বত্র টহলদারি চলছে। সোমবারেও দিনহাটায় কাঠ বোঝাই একটি গাড়ি আটক করা হয়েছে।’’ কাঠচুরি যে চলছে তা স্বীকার করে নিয়েই আবার বিগত বাম শাসনকে দায়ী করেছেন বনমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “চৌত্রিশ বছরের রোগ সারানো একদিনে সম্ভব নয়। তবে কাঠচুরি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।”
বনকর্মীদের একাংশের দাবি, বর্তমান পরিকাঠামো নিয়ে সর্বত্র টহলদারি চালানো সম্ভব নয়। জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার কোচবিহার জেলা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ষোলশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে জঙ্গল রয়েছে। গভীর রাতে সবজায়গায় নজর রাখা সম্ভব নয়। এক বনকর্মীর কথায়, “আমাদের হাতে তো দোনলা বন্দুক। যারা রাতে কাঠচুরি করে তারা সংখ্যায় বেশি, আধুনিক অস্ত্র থাকে।”
এ তো গেল রাতের কথা। দিনে দুপুরেও কাঠচুরি চলছে বলে দাবি। গাছ কাটার পরে পাচারের নিত্যনতুন উপায়ও চলছে। কোথাও চেরাই করা কাঠের ওপরে পটল, উচ্ছে বোঝাই ঝুড়ি বসিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, কোথাও আবার নদীতে ভোর বেলায় কাঠ ভেসে যেতে দেখা যায়। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy