Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেঘে ঢাকা মেধা

অর্জিত জ্ঞানকে ঢেকে দিচ্ছে অজ্ঞানতার আস্ফালন। বাংলা তথা ভারতে সারস্বত সাধনার এই দুর্দিন কি কেটে যাবে, ঝলমলে শারদ প্রাতে উত্তর খুঁজলেন সোহিনী মজুমদারকিন্তু ঘটনাচক্রে ছেলেবেলারও প্রকারভেদ আছে। মেয়েদেরও ‘বিয়ের বয়স’ আছে। ‘গৌরীদান’ না করলে মেয়ের বিয়ে আটকে যাওয়ার ঘটনা আগের চেয়ে কমলেও এখনও বিরল নয়। দিন আনি দিন খাই-সংসারে এক জন সদস্যকে পার করে দিলে ভারও খানিকটা লাঘব হয় বৈকি।

অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ

অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৫:১৮
Share: Save:

কী জানি এত ক্ষণে হয়তো মায়ের মুখ হল রং করা… মনে মনে কান পাতলেই যেন মিষ্টি মধুর ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। তার মানে তো হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা আর সিমেস্টারের গুচ্ছের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। পুজোর সময়ে পাঠশালার ওই পাঠে মুখ গুঁজে থাকাটা যে কতটা বেদনাদায়ক, সে কথা কবে কোন গুরুমশাই বুঝেছেন। সনৎ সিংহের আপনজনের মতো কণ্ঠস্বরের আশকারা না থাকলে কঠিন লড়াইয়ের দিনে যে কাকে পাশে পেতাম বলা যায় না! সনৎবাবুই বিবেচনা করে আমাদের হয়ে খোলা চিঠি লিখেছিলেন বিদ্যেবতী সরস্বতীকেও। তাঁর অবদান ভোলার নয়। তবে পুজোর আগে ওই উমার মতো কঠোর তপস্যায় দিনরাত্রিযাপন, উমা আসার পরে ছুটির আনন্দ যেন দ্বিগুণ করে দিত। পড়ার সমুদ্র ডিঙিয়ে যেন অর্জন করে নিতাম ‘জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা’।

কিন্তু ঘটনাচক্রে ছেলেবেলারও প্রকারভেদ আছে। মেয়েদেরও ‘বিয়ের বয়স’ আছে। ‘গৌরীদান’ না করলে মেয়ের বিয়ে আটকে যাওয়ার ঘটনা আগের চেয়ে কমলেও এখনও বিরল নয়। দিন আনি দিন খাই-সংসারে এক জন সদস্যকে পার করে দিলে ভারও খানিকটা লাঘব হয় বৈকি। বিশেষত সে উপায় যখন সমাজসিদ্ধ। দেড়শো বছরেরও বেশি দিন পেরিয়ে গেল বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু মানসিকতার ভিত এত বছরের আন্দোলনেও পুরোপুরি টলে না। আমাদের ছেলেবেলার লড়াই ছিল পড়া থেকে কী করে একটু রেহাই পাব, তার জন্য। আর চোপড়ার অন্তরা সিংহ, হবিবপুরের মৌসুমি দাস, শান্তি সাহানিরা আজও লড়াই করে চলেছে সুস্থ ভাবে পড়াটুকু চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির ‘তত্ত্বাবধানে’ পড়াশোনা যে খুব বেশি এগোয় না, পাড়ার আর পাঁচটা মেয়ে বাপের বাড়ি ফিরলে সে কথা বোধহয় ওরা কানাঘুষোয় শুনেছে। বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল শুনেই তাই এক মুহূর্ত দেরি করেনি নবম শ্রেণির অন্তরা। স্কুলেরই সিনিয়র ছাত্রীদের জানিয়ে শিক্ষকদের আর প্রশাসনের সাহায্যে পরিকল্পনা করে নিজের বিয়ে ভেস্তে দেয় সে। নিজের বিয়ে রুখে জেলায় সেরা কন্যার সংবর্ধনা পাওয়ার পরে লাজুক মুখে মৌসুমি বলেছিল, “অন্তত স্কুলের পড়াটা শেষ করতে দেওয়া হোক আমাদের।’’

লেখাপড়ার পথে আজও মেয়েদের বাধা কি আর একটা! স্কুলের শিক্ষকের হাতেই যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে ছাত্রী। ইংরেজবাজারের একটি হাইস্কুলে নিগ্রহের বিরুদ্ধে সচেতনতার ক্লাসে গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণির দুই ছাত্রীর। সঙ্কোচে কুঁকড়ে কোনও মতে ওরা জানায়, স্কুলেরই দুই শিক্ষক..। স্কুলে আগুন জ্বলে। নিগ্রহের অভিযোগে গ্রেফতার হন শিক্ষক মহোদয়রা। আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় খুদে মেয়ে দু’টোর লড়াই দেখে। পড়া ওরা থামায়নি। ভয়, বাধা কাটিয়ে অত্যাচারের প্রতিবাদে মুখ খুলেছে। হোক না সে প্রতিবাদের ভাষা শুধুই চোখের জল।

প্রতিবাদের স্বর বা শুধু ভিন্ন স্বর শুনলে, চাইলেই এখন তাকে পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া যায়। তার উপরে কলমের আঁচড় বা ছাপার অক্ষর চিরকালই স্বৈরতন্ত্রের বড় শত্রু। তাই গৌরী লঙ্কেশ, এমএম কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকরের মতো কত জনের কলম নিঃশব্দে থামিয়ে দেওয়া যায়। যেমন প্যারিসের শার্লি এবদোয় থেমে যায় শিল্পীদের তুলি অথবা কলমে ব্যঙ্গচিত্রের টান। যে ভাবে নিজের দেশে ফিরে ভরা মেলায় খুন হয়ে যান বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগ-লেখক। কারা এই সন্ত্রাসের কারিগর? জানা যায় না। ফলে কারও শাস্তিও হয় না। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেও আত্মহত্যার পথ বাছেন দলিত ছাত্র। আবার কোনও এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করায় হাজতবাস করতে হয়, ডিগ্রি হারানোর ভয়ে দিন কাটাতে হয় ছাত্রদেরই। পার পান না সম্মাননীয় শিক্ষাবিদরাও। সারা জীবন ধরে মূল্যবান গবেষণায় নিজে হাতে ইতিহাসের অদেখা দরজা একে একে খোলার পরে অধ্যাপক হিসেবে এমিরেটাস রোমিলা থাপারের কাছে কাজের খতিয়ান চায় বিশ্ববিদ্যালয়। কেবলমাত্র রাজনীতিতে ক্ষমতার জোরে অমর্ত্য সেনের শিক্ষা নিয়ে অবলীলায় প্রশ্ন তোলেন নেতা।

অজ্ঞানতাবশত বা হয়তো জ্ঞানতই রাজনীতির আঙিনা যেন অশিক্ষার উদ্‌যাপনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য সব তথ্য ইদানীং জানতে পারি আমাদেরই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে। কখনও শুনছি বিদ্যাসাগর সহজপাঠ লিখেছিলেন, সতীদাহপ্রথা রদ করেছিলেন, কখনও শুনছি তিনি নাকি ফলক দেখে মাইলও আবিষ্কার করেছিলেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় জানতাম, অর্জিত জ্ঞানই ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করে। এখনকার পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে অজ্ঞানতার আস্ফালনই ক্ষমতা অর্জনের এবং তা অবিচল রাখার যন্ত্র হয়ে উঠছে। বরাদ্দ কমছে উচ্চশিক্ষাখাতে। ২০১৩-১৪ অর্থনৈতিক বর্ষে কেন্দ্রীয় বাজেটের ৪.৭৭ শতাংশ বরাদ্দ ছিল শিক্ষায়। ২০১৮-১৯ বর্ষে তা দাঁড়ায় ৩.৪৮ শতাংশে। অনিয়মিত হয়েছে শিল্পীভাতা। এনসিইআরটির পাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। আবার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাথ সাহা, সত্যেন বসুর দেশে চন্দ্রযান ছাড়ার আগে পুজো দিচ্ছেন মহাকাশবিজ্ঞানী।

জাঘিনা তাক্‌ তা ধিনা, তাক্‌ তা ধিনা, তাক্‌ কুর কুর…। ও দিকে মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্যির লয় বেড়ে চলেছে। মহালয়ার ভোরে শ্রীশ্রীচণ্ডিকার আবাহনমন্ত্রে শুনি, ‘তিনি পরিণামিনী নিত্যার্দিভ্যর্চৈতন্যসৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় (নিত্যঃ-আদিভ্যঃ-চৈতন্য-সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায়) যে শক্তির মধ্য দিয়ে ক্রিয়াশীলরূপে অভিব্যক্ত হন, সেই শক্তি বাক্‌ অথবা সরস্বতী; তাঁর স্থিতিকালোচিত শক্তির নাম শ্রী বা লক্ষ্মী; আবার সংহারকালে তাঁর যে শক্তির ক্রিয়া দৃষ্ট হয় তা-ই রুদ্রাণী দুর্গা। একাধারে এই ত্রিমূর্তির আরাধনাই দুর্গোৎসব’। শ্রীশ্রীচণ্ডীর নারায়ণীস্তুতি বলছে, “হে দেবি, বেদাদি অষ্টাদশ বিদ্যা আপনারই অংশ। চতুঃষষ্টি-কলাযুক্তা, আপনি সর্বভূতস্বরূপা। হে দেবি, আপনি সকল ব্যক্তির হৃদয়ে বুদ্ধিরূপে অবস্থিতা। দেবি, আপনি মেধারূপা, বাগ্‌দেবী, সর্বশ্রেষ্ঠা।’’

বিদ্যার এই দৈন্য-দিনে সর্বভূতে চেতনারূপে বিরাজমানা সেই দেবীর স্তব করি। রোদ ঝলমলে শারদপ্রাতে অজ্ঞানতার মেঘ কেটে যাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2019 Festive Season
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE