Advertisement
০২ মে ২০২৪

ঢাকার জেরে কমেছে পারাপার

জঙ্গিহানার পরে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে সীমান্তের দু’পারেই। সীমান্ত পেরিয়ে কারা আসছেন, কারা যাচ্ছেন তা সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতে হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের প্রোফাইলও। যেখানে কাঁটাতারের বেড়া নেই, বিএসএফ জওয়ানের সংখ্যা বেড়েছে। কয়েক দফা তল্লাশির পর্ব পার করতে হচ্ছে উত্তরবঙ্গের স্থলবন্দর কেন্দ্র দিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদেরও। রবিবার মালদহের মহদিপুর, কোচবিহারের চ্যাংরাবান্ধা, শিলিগুড়ি লাগোয়া জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ি এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি অভিবাসন কেন্দ্রে রবিবার আনন্দবাজার ঘুরে দেখল পরিস্থিতি।সীমান্তে নজরদারিতে মহিলা জওয়ানদেরও নামানো হয়েছে মহদিপুরে। এ ছাড়া সীমান্ত লাগোয়া গাড়িগুলিতেও তল্লাশি চালাচ্ছে বিএসএফ। ওপার বাংলা থেকে আসা ইংরেজবাজারের বাসিন্দা সাদ্দাম শেখ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জে আত্মীয়দের বাড়িতে সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এ বারের ইদ সপরিবারে আত্মীয়ের বাড়িতেই কাটাব।

সীমান্তে বিএসএফ-র কড়া নজরদারি। ছবি:  সন্দীপ পাল

সীমান্তে বিএসএফ-র কড়া নজরদারি। ছবি: সন্দীপ পাল

নিজস্ব সংবাদদাতা
মহদিপুর শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০২:০০
Share: Save:

সীমান্তে নজরদারিতে মহিলা জওয়ানদেরও নামানো হয়েছে মহদিপুরে। এ ছাড়া সীমান্ত লাগোয়া গাড়িগুলিতেও তল্লাশি চালাচ্ছে বিএসএফ। ওপার বাংলা থেকে আসা ইংরেজবাজারের বাসিন্দা সাদ্দাম শেখ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জে আত্মীয়দের বাড়িতে সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এ বারের ইদ সপরিবারে আত্মীয়ের বাড়িতেই কাটাব। সংবাদ মাধ্যমে দেখছি ঢাকাতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে। তাই আতঙ্কে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে এলাম।’’ এ দিকে, বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘‘ঘটনাটি জানার পর থেকেই বাড়ি ফেরার জন্য মন কেমন করছে। আত্মীয় স্বজনদের নিজের চোখে দেখার পর যেন মন শান্তি পাবে। তাই সপরিবারে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’’ ভারত-বাংলাদেশ নাগরিকদের যাতায়াত স্বাভাবিক থাকলেও আমদানি রফতানি বন্ধ ছিল। এক্সপোর্টার্স সূত্রে জানা গিয়েছে, ইদ উপলক্ষে ন’দিনের জন্য বাণিজ্য কেন্দ্রে আমদানি-রফতানি বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী ৯ জুলাই ফের গাড়ি চলাচল করবে। মহদিপুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘‘খালি ট্রাকগুলি চলছে। ইদের পর ফের আমদানি রফতানি চলবে।’’

চ্যাংরাবান্ধা

কাঁটাতারের বেড়ার এ-পার ও-পারে দাঁড়ানো মানুষজনের মধ্যে গল্পগুজব চলছে। কেউ হয়ত বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দিলেন, ও দিক থেকে উড়ে এল কেকের প্যাকেট। এমন দৃশ্য চ্যাংরাবান্ধা সীমান্তে পরিচিত। যদিও রবিবার কাঁটাতারের বেড়ার দিকে এগোতেই বিএসএফ জওয়ানদের ধমক খেতে হয়েছে। চ্যাংরাবান্ধার বন্দরের দুই দেশের গেট প্রায় গা-ছুঁয়েই। সে কারণেই বেড়ার দু’দিকে থাকা গ্রামের বাসিন্দারা ও পারে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে সীমান্ত না পার হয়েই দেখা করতে পারেন। বেড়ার পাশে এসে দাঁড়ালেই হয়। কিন্তু গত দু’দিনেই যেন বদলে গিয়েছে সীমান্ত। ভিড় নেই। নেই সেই ব্যস্ততাই। শনিবার থেকে সীমান্ত যেন অনেকটা ফাঁকা। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, এই দু’দিনে ৫০০ জনের কিছু বেশি মানুষ চ্যাংরাবান্ধা সীমান্ত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াত করেছে। প্রতিদিন ২৫০ জনের উপরে যাতায়াত করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মানুষের সংখ্যা বেশি। দুদিন আগেই ওই সংখ্যা দ্বিগুণ ছিল। প্রতিদিন ৫০০ জনের উপরে মানুষ যাতায়াত করত। বিএসএফের পক্ষ থেকেও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। শনিবারই পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও যৌথ বৈঠক করে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। যাতে স্থানীয় মানুষরাও সতর্ক থাকেন। মেখলিগঞ্জের বাসিন্দা চিরন্তন রায় বলেন, ‘‘প্রতি রবিবার বা ছুটির দিনে বেড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। ও পারের গ্রামে থাকা আমার আত্মীয়রাও আসতেন। বেড়ার এ-পার ও-পার থেকে কথা চলত। এ দিন তো বেড়ার কাছে যাওয়া দূরের কথা, ও দিকে তাকালেই বিএসএফ জওয়ানরা ছুটে আসছে।’’


বাংলাদেশে জঙ্গিহানার পরে শিবরামপুর সীমান্তে চলছে নজরদারি। ছবি: অমিত মোহান্ত।

ফুলবাড়ি

সদা ব্যস্ত ফুলবাড়ি অভিবাসন কেন্দ্রটি রবিবার দুপুরে যেন খাঁ খাঁ করছিল। ইদের ছুটির কারণে পণ্যবাহী ট্রাক যাতায়াত বন্ধ। সীমান্তের দিকে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে বোল্ডার বোঝাই ট্রাকের সারি। অভিবাসন কেন্দ্রের আশেপাশে খাবারের দোকান বন্ধ। একটি মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের ঝাঁপ সকালের পরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার সামনে জনা কয়েক বন্দুকধারী পুলিশকর্মী। ইমিগ্রেশন সেল সূত্রে জানা গেল, রবিবার দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ফুলবাড়িতে এসেছেন মাত্র ১১ জন। তার মধ্যে দু’জন ভারতের নাগরিক। তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, মাস চারেক আগে চালু হয়েছে এই অভিবাসন কেন্দ্র, তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা নাগরিকদের সংখ্যা এ দিনই ছিল সব চেয়ে কম। সূত্রের খবর, সীমান্তে কড়াকড়ির জেরেই যাতায়াতের সংখ্যা কমেছে। বাংলাদেশে পঞ্চগড়ে অভিবাসন কেন্দ্র পার হয়ে শুল্ক দফতরের কর্মীদের পাহারায় দিনাজপুরের বাসিন্দা সীতারানি রায় দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ ফুলবাড়ি কেন্দ্রে ঢুকেছেন। বার কয়েক তাঁর ব্যাগ পরীক্ষা করা হয়েছে। তারপর ডাক পড়েছে একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদে। যে হোটেলে থাকবেন বলে জানিয়েছেন, সেখানে ফোন করে কেন্দ্রের আধিকারিকরা যাচাই করে নিয়েছেন। কেন ভারতে আসছেন, তাও অন্তত বার পাঁচেক নানা অফিসার জিজ্ঞাসা করেছেন। অভিবাসন কেন্দ্রে বসেই সীতারানিদেবী বলেন, ‘‘এর আগেও এই কেন্দ্র দিয়ে ঢুকেছি। কোনও দিন এত তল্লাশির মধ্যে পড়তে হয়নি।’’ আধিকারিকদের দাবি ‘উপর’ থেকে নির্দেশ আসাতেই কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। ঢাকায় হামলার পরে বাংলাদেশ জুড়ে তল্লাশি শুরু হয়েছে, সে কারণে সন্দেহভাজন অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই যাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসছেন তাঁদের ফেসবুক-টুইটার প্রোফাইলও যাচাই করে দেখা হচ্ছে ফুলবাড়ি অভিবাসন কেন্দ্রে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘যাঁরা আসছেন প্রয়োজনে ওই ব্যক্তির সোশাল নেটওয়ার্কের প্রোফাইলও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রোফাইলে সন্দেহজনক বা উস্কানিমূলক কোনও পোস্ট বা লিঙ্ক থাকলে তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’’ আগে যেখানে এক জনকে তল্লাশি করে ইমিগ্রেশন শংসাপত্র দিতে আধঘণ্টা লাগত, এখন তাই দেড় থেকে দু’ঘণ্টা লাগছে। সে কারণেই যাতায়াতের সংখ্যা কমে গিয়েছে বলে দাবি। যাঁরা আসছেন, তাঁরাও আতঙ্কিত। এ দিন বাংলাদেশ থেকে আসা মহম্মদ মেহেদি হাসান খান বলেন, ‘‘আমি ব্যবসার কাজে এসেছি। গত শুক্রবারের ঘটনা তো আতঙ্ক বাড়িয়েছে। আশা করছি দ্রুত আমার দেশ সে আতঙ্ক কাটিয়ে তুলতে পারবে।’’ রবিবার হলেও অভিবাসন কেন্দ্র খোলাই থাকে। যদিও, কড়াকড়িতে এই রবিবার অভিবাসন কেন্দ্রেও অঘোষিত ছুটির ছোঁয়া, আতঙ্কেরও।

হিলি

পাহারা-তল্লাশি বাড়লেও ছন্দপতন হয়নি হিলি সীমান্তে। দু’দেশের বহির্বাণিজ্য স্বাভাবিক রয়েছে। পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের মাধ্যমে উভয় দেশের মানুষের যাতায়াত চালু রয়েছে। শনিবার থেকে হিলি সহ জেলার সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কড়া পাহারা ও নজরদারি চালাচ্ছে। হিলিতে বিএসএফের অতিরিক্ত জওয়ান ও অফিসার নামানো হয়েছে। এ দিন সকাল থেকে হিলির যে এলাকায় কাঁটাতার নেই সেই পূর্ব আপতোর, উজাল, হাড়িপুকুর, গোবিন্দপুর, দক্ষিণপাড়া, ঘাসুরিয়া সীমান্ত গ্রামে বিএসএফের তরফে একাধিক নাকা পয়েন্ট করে নজরদারি ও তল্লাশি চালাতে দেখা গিয়েছে। হিলি বাজার, ব্লক অফিস এবং হাসপাতাল মোড়ে পুলিশও মোতায়েন ছিল। এ দিন হিলি দিয়ে ১২০টি ট্রাক বাংলাদেশে গিয়ে পণ্য খালস করেছে। ওপার থেকে এপারে এসেছে কয়েক ট্রাক চিটে গুড়। স্থানীয় এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্ট সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, হিলি দিয়ে রোজ গড়ে ১১লক্ষ ৭০ হাজার ডলার বহির্বাণিজ্য হয়। এ দিন সকালে বাংলাদেশ থেকে হিলি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে বালুরঘাটের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন আওয়ামি লিগের দিনাজপুর জেলার উপদেষ্টা সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান, হিলি উপজেলা আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক শাহিনুররেজা শহিন, জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মহম্মদ হাকিম মণ্ডল, হিলি বন্দর উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি আবুল কাসেম আজাদ এবং হিলি আমদানি রফতানিকারী গ্রুপের আহবায়ক মহম্মদ হারুনুর রশিদ। তাঁদের দাবি, ওপারে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। হিলি দিয়ে বহির্বাণিজ্য চালু রয়েছে। এদিন বিকেল ৩টা নাগাদ দলটি বাংলাদেশে ফিরে যান। বালুরঘাটের রফতানি বাণিজ্যের প্রতিনিধি বিকাশ মণ্ডল বলেন, ‘‘ইদ উপলক্ষে আগামী মঙ্গলবার, ৫ জুলাই থেকে হিলি চোকপোস্ট দিয়ে বহির্বাণিজ্য বন্ধ থাকবে। ইদের অনুষ্ঠান শেষ হলে ফের দু’দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চালু হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dhaka incident terror
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE