Advertisement
০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রয়াত চিত্তভূষণ, সঙ্গী হারাল চরকা

থেমে গেল চরকা। চলে গেলেন মানবাজারের মাঝিহিড়া জাতীয় বুনিয়াদি আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শতায়ূ স্বাধীনতা সেনানি চিত্তভূষণ দাশগুপ্ত। রেখে গেলেন চার ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি এবং গুণমুগ্ধদের।

সমীর দত্ত
মানবাজার শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:০৯
Share: Save:

থেমে গেল চরকা। চলে গেলেন মানবাজারের মাঝিহিড়া জাতীয় বুনিয়াদি আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শতায়ূ স্বাধীনতা সেনানি চিত্তভূষণ দাশগুপ্ত। রেখে গেলেন চার ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি এবং গুণমুগ্ধদের। তাঁদের ব্যাখ্যা, চিত্তভূষণবাবুর প্রয়াণের সঙ্গে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।

তাঁর পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯১৫ সালের ৬ জুন পটনাতে তাঁর জন্ম। পটনায় এম ই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার পর বাবা নিবারণচন্দ্রের সঙ্গে তিনি পুরুলিয়ায় আসেন। তারপর থেকে পুরুলিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর ছেদ হয়নি। সেই পুরুলিয়ার মাটিতেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ফেললেন। ২০১১-এর নভেম্বরে তাঁর সহধর্মিনী মালতী দাশগুপ্ত প্রয়াত হন। স্বাধীনতা সেনানি মালতীদেবী জন্মসূত্রে মারাঠী ছিলেন।

তবে পুরুলিয়া শুধু নয়, বাংলার মানুষ তাঁকে মনে রাখবেন তাঁর কাজের জন্য। ইংরেজদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে চিত্তভূষণবাবুর বাবা নিবারণচন্দ্র সরকারি চাকরি ছেড়ে দেশের কাজে নেমে পড়েন। বাবার পথ অনুসরণ করেন দুই ছেলে বিভূতিভূষণ ও চিত্তভূষণ। পরে বিভূতিভূষণবাবু যুক্তফ্রন্ট সরকারে মন্ত্রী হন।

এ দিন তাঁর পরিবার পরিজন ও গুণমুগ্ধদের কথায় বারবার চিত্তভূষণবাবুর অতীত জীবনের কথা উঠে এসেছে। সাংঠনিক দক্ষতা ও তাঁর সুবক্তা হিসাবে প্রমাণ ছোটবেলাতেই মেলে। ১৯২৭ সালে পুরুলিয়ার রামচন্দ্রপুরে মানভূম কংগ্রেস কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকদেরও জাতীয় আন্দোলন নিয়ে বলার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সম্মেলনে ১২ বছরের চিত্তভূষণ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বক্তব্যে সুভাষচন্দ্র বসু মুগ্ধ হয়েছিলেন। চিত্তবাবুর পিঠে হাত রেখে নেতাজি জানিয়েছিলেন, একদিন তিনি অনেক বড় হবেন।

১৯৩০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সের কিশোর চিত্তভূষণ পুরুলিয়া থানার পাশে মদভাটি উচ্ছেদের দাবিতে পিকেটিং করেন। ইংরেজ সরকারের পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। চিত্তভূষণের তিন মাস জেল হয়। ১৯৩৮ সালে পটনায় গর্ভনমেন্ট বেসিক ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হয়ে চিত্তভূষণবাবু ফের পড়াশোনা শুরু করেন। রাঁচিতে গাঁধীজিকে প্রথম দেখেন চিত্তভূষণবাবু। পরে চম্পারণ কনফারেন্সে একটি শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি গাঁধীজির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গাঁধীজি জানিয়েছিলেন, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয়দের উন্নতি সম্ভব নয়। এ জন্য বুনিয়াদি শিক্ষার প্রয়োজন। গাঁধীজির এই ভাবনা চিত্তভূষণের মনে গেঁথে গিয়েছিল। দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে পুরুলিয়ার মানবাজার ও বরাবাজার থানার সীমানায় মাঝিহিড়া গ্রামে ১৯৪০ সালে মাঝিহিড়া জাতীয় বুনিয়াদি আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপন করেন চিত্তভূষণবাবু। সেই স্কুল এখনও চলছে। আশ্রম বিদ্যালয়ের বর্তমান কর্ণধার চিত্তভূষণের ছোটছেলে প্রসাদ দাশগুপ্তের দাবি, ‘‘পূর্ব ভারতে এটিই প্রথম বেসরকারি বুনিয়াদি বিদ্যালয়।’’

জঙ্গলে ঘেরা মাঝিহিড়া আশ্রম বিদ্যালয় তখন স্বাধীনতা সেনানিদের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ সরকারের পুলিশের সন্দেহের তালিকা থেকে এই বিদ্যালয় তাই রেহাই পায়নি। ১৯৪২ সালে ইংরেজ সরকার আশ্রম বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। সেই সময় চিত্তভূষণবাবু বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে এক হওয়ার জন্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় সভা করে বেড়ান। ১৯৪৬ সালে আশ্রম বিদ্যালয় ফের চালু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে এসে মাঝিহিড়া বিদ্যালয় পুনর্গঠনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীন হলেও পুরুলিয়ায় লড়াই তখনও শেষ হয়নি। মানভূম জেলা পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তে বিহারে থেকে যাওয়ায় জাতীয় নেতাদের সঙ্গে জেলার কংগ্রেস নেতাদের মতবিরোধ শুরু হয়। জেলা নেতাদের দাবি ছিল, এই এলাকার বাসিন্দাদের মাতৃভাষা বাংলা। কাজেই ওই এলাকাকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলা হয়। কংগ্রেসের জাতীয়স্তরের নেতারা এই দাবি মানেননি। শেষে পুরুলিয়া জেলায় কংগ্রেসের প্রায় সমস্ত শীর্ষ স্তরের নেতারা একযোগে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। গঠিত হয় লোকসেবক সঙ্ঘ। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। শেষে ১৯৫৬ সালে ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রায় মেনে মানভূম জেলা ভেঙে পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই আন্দোলনেও মাঝিহিড়া আশ্রম বিদ্যালয় পুরোভাগে ছিল।

আজীবন গাঁধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত চিত্তভূষণ মনে করতেন, বুনিয়াদি শিক্ষাই প্রকৃত মানুষ গড়ে তুলতে পারে। নির্লোভ সদা হাস্যময় মানুষটি শিক্ষক হিসাবে ‘দ্য টেলিগ্রাফ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারি ভাবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তণীরা এখন দেশে-বিদেশি প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান ও প্রাক্তণীদের নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৫ বছরে পা দেওয়ার অনুষ্ঠান হয়। চিত্তভূষণবাবু চলে গেলেও রেখে গেলেন তাঁর হাতে গড়া বিদ্যালয়টি। আর তাঁর আদর্শ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy