—ফাইল চিত্র।
ক্লাস সবে শুরু হয়েছে। মিড ডে মিল রান্নার দায়িত্বে থাকা কর্মী তখনও পৌঁছননি। প্রধান শিক্ষিকা তাপসী গোস্বামী চা করার জন্য মিড ডে মিলের রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের স্টোভ জ্বালাতেই রান্নাঘরে আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। হাসপাতালে কয়েক দিন লড়াই করে মারা যান তাপসী। হাওড়ার ভট্টনগরের দিবাকর ভট্ট এস আর সারদামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত মাসের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, মিড ডে মিলের পরিকাঠামোর হাল।
ওই স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, মিড ডে মিল রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিক গ্যাস স্টোভ। অথচ তা জ্বালানোর জন্য ব্যবহার করা হয় সাধারণ পাইপ। ফলে অনেক সময়ে সেই পাইপ ঠিকমতো লাগানো যায় না। স্কুলের শিক্ষক শুভাশিস কর বলেন, ‘‘বাণিজ্যিক পাইপের দাম অনেকটা বেশি।
বেশির ভাগ স্কুল তা কিনতে পারে না। ফলে সাধারণ পাইপ ব্যবহার করা হয়। আমাদের স্কুলেও সেটাই হচ্ছিল। প্রধান শিক্ষিকার জীবনের মূল্যে হুঁশ ফিরল। এখন পাইপ বদলানো হয়েছে।’’ প্রশ্ন উঠছে, রান্নাঘরের পরিকাঠামোয় শিক্ষা দফতরের কোনও নজরদারি থাকবে না কেন? এরকম ঘটনা যে আরও ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
অভিযোগ, পানীয় জলের ক্ষেত্রেও। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ স্কুলে মিড ডে মিল রান্না ও খাওয়ার জন্য পাম্পের জল ব্যবহার করা হলেও গ্রামাঞ্চলে নলকূপের জলই ভরসা। শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, “জঙ্গলমহল, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার স্কুলে মিড ডে মিলের ক্ষেত্রে নিরাপদ পানীয় জলের অভাব সব থেকে বেশি। গ্রীষ্মকালে ওই সব এলাকায় বেশির ভাগ স্কুলের নলকূপ থেকে জল ওঠে না। স্কুল থেকে অনেক দূরে হয়তো কোনও ঝর্ণা বা পুকুরের জল তুলে রান্না হয়। সেই জলকেই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার হয়। তার জেরে জলবাহিত রোগ হওয়ার অভিযোগও আমাদের কাছে এসেছে অনেকবার।“
শিক্ষক নেতা তথা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নবকুমার কর্মকারের অভিযোগ, ‘‘অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্নার অভিযোগও রয়েছে প্রচুর। খাবারে টিকটিকি পড়ে থাকার অভিযোগও উঠেছিল।’’ ২০২৩ সালে জানুয়ারি মাসে বীরভূমের ময়ূরেশ্বর মণ্ডলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের ডালের বালতিতে ছিল মরা চিতি সাপ। এই নিয়ে সেই সময়ে বিস্তর গোলমাল হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও পরিস্থিতির উন্নতি আদৌ হয়েছে কি?
হাওড়ার চকপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করা হয় সিঁড়ির তলায়। স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, বেশি বৃষ্টি হলেই রান্নাঘরে এক হাঁটু জল জমে যায়। জমা জলে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয়। ওই রান্না করার জায়গাতেই রয়েছে বিদ্যুতের মিটার বক্স। বৃষ্টিতে কোনও কারণে মিটার বক্সে শর্ট সার্কিট হয়ে গেলে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, সাগর এলাকার বহু স্কুলের মিড ডে মিলের রান্নাঘর ও খাওয়ার ঘরের বেহাল অবস্থা। এই সব প্রত্যন্ত এলাকার অনেক স্কুলে সেই আমপানের সময়ে রান্নাঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল। এখনও তা সারানো হয়নি। কুলতলির সোনাটিকারি আদিবাসী এফপি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশ নস্কর বলেন, ‘‘আমার স্কুলের রান্নাঘরের চাল ভেঙে গেছে আমপানের সময়ে। শিক্ষা দফতরকে ছবি সমেত অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি।’’ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলপির সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বন্দনা ঘোষ জানান, খাওয়ার ঘরের ছাদ আমপানে ভেঙে যাওয়ায় পড়ুয়ারা এখন বারান্দায় বসে মিড ডে মিল খায়। খর রোদে বা জোর বৃষ্টির সময়ে খুব কষ্ট হয় তাদের।
এ বার বাজেটে মিড ডে মিলের বরাদ্দ ছিটেফোঁটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিকাঠামো আরও বেহাল হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন শিক্ষকেরা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মিড ডে মিল অসংখ্য দরিদ্র শিশুর স্কুলছুট হওয়া আটকায়। তা হলে কেন পরিকাঠামোর উন্নতি করা হবে না?
যদিও শিক্ষা দফতরের এক কর্তার দাবি, ‘‘রাজ্যের মিড ডে মিল ব্যবস্থা দেখার জন্য, গত বছর জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষজ্ঞ দল জেলায় জেলায় ঘুরেছিল। পরে তারা রিপোর্টে রাজ্যের পরিকাঠামোর প্রশংসা করে।“
বাস্তব অবশ্য তা বলে না।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy