Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাত দিনই স্কুল খোলা লাকায়

বরাবাজার থানার লাকা গ্রামে কোনও দর্শনীয় স্থান নেই। তাতে অবশ্য কোনও আক্ষেপও নেই বাসিন্দাদের। আত্মীয়েরা এলে তাঁদের প্রাথমিক স্কুল দেখাতে নিয়ে যান। কারণ, তাঁদের মতে, এই স্কুল সত্যিই দর্শনীয়।

এ ভাবেও শিক্ষা। নিজস্ব চিত্র

এ ভাবেও শিক্ষা। নিজস্ব চিত্র

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৮ ০৮:১০
Share: Save:

গাঁয়ে দুর্গাপুজো হয়, কালীপুজোও হয়। অন্যান্য পালা পার্বনেও মেতে ওঠেন বাসিন্দারা। তবে যে কোনও উৎসবে গল্প-আড্ডায় গাঁয়ের স্কুলের প্রসঙ্গ উঠবেই। কারণ, স্কুলই তাঁদের গর্ব।

বরাবাজার থানার লাকা গ্রামে কোনও দর্শনীয় স্থান নেই। তাতে অবশ্য কোনও আক্ষেপও নেই বাসিন্দাদের। আত্মীয়েরা এলে তাঁদের প্রাথমিক স্কুল দেখাতে নিয়ে যান। কারণ, তাঁদের মতে, এই স্কুল সত্যিই দর্শনীয়।

লাকা গ্রামে ৩০০ পরিবারের বাস। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, আগে লোকের বাগান বা খামার থেকে আম, কলা, নারকেল উধাও হয়ে যেত। পুজোর সময় গাছ থেকে ফুলও চুরি যেত। কিন্তু, এখন সে সব বন্ধ। কারণ, লাকা প্রাথমিক স্কুলই ছেলেমেয়েদের ও সব করতে বারণ করেছে।

এই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১১১। শিক্ষক শিক্ষিকা পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন পার্শ্বশিক্ষক। ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শরৎ পরামাণিক এই স্কুলে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘‘এই স্কুলের হাত ধরে গ্রামে পরিবর্তন এসেছে। এখন এক জন পড়ুয়াও স্কুলছুট নেই। স্কুলে উপস্থিতির হার ৯৫ শতাংশ। যে পড়ুয়ার স্কুলে উপস্থিতির হার সব থেকে বেশি সেই পড়ুয়াকে উৎসাহ দিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কৃত করা হয় তার অভিভাবককেও।’’ স্কুলে আনাজের বাগান রয়েছে। সব মরসুমের আনাজই মিড-ডে মিলে স্কুল পড়ুয়াদের পাতে দেওয়া হয়। স্কুলের ছাদেও আলাদা ভাবে আনাজ ও ফুলের বাগান তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সালে শরৎবাবু জাতীয় শিক্ষকের সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

বাসন মাজা, হাত ধোয়া ইত্যাদি নানা কারণে জলের খরচ হয়। নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে জলের অপচয় রুখতে শিক্ষকেরা স্কুলে একটি চৌবাচ্চায় ওই জল ধরে রাখছেন। সেই চৌবাচ্চায় নীচে কাঠ কয়লা, বালি ও চুন দেওয়া রয়েছে। রয়েছে পলিমাটিও। ছাড়া হয়েছে গেঁড়ি ও গুগলি। জলে ফুটেছে শালুক। সেই জল পানীয় হিসাবে ব্যবহার না করা হলেও, হাত ধোয়া, গাছের গোড়ায় জল দেওয়া হয়। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘অভিভাবক ও সহ-শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সহযোগিতা ছাড়া এ সব সম্ভব হত না।’’

শিক্ষক অমিত চৌধুরী, শিক্ষিকা রীতা মাহাতোরা বলেন, ‘‘শুধু এ গ্রামেই ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ে তা নয়। তিন ভাগের এক ভাগ পড়ুয়া এখানে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে।’’ যেমন, তৃতীয় শ্রেণির অনিলা মাহাতোর বাড়ি বাঘমুণ্ডিতে। লাকায় মাসির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে। চঞ্চল মাহাতোর বাড়ি বান্দোয়ানে, অসীম মাহাতোর বাড়ি বরাবাজারে। তারাও লাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে।

গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ মাহাতো, রঞ্জিত মাহাতোদের দাবি, এই স্কুল পড়ানোর পাশাপাশি পড়ুয়াদের চরিত্র গঠনও করে। স্কুলে ব্রতচারী, নাচ, হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সপ্তাহের সাত দিনই স্কুল খোলা থাকে। যে সমস্ত পড়ুয়া অসুস্থতার জন্য কিংবা বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে থাকে, তাদের শনিবার বিকাল ও রবিবার সকালে বিশেষ কোচিংয়ের ব্যবস্থাও থাকে। প্রধান শিক্ষক নিজেই কোচিং ক্লাস নেন।

বিডিও (বরাবাজার) শৌভিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘লাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাল কাজ করছে। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে স্কুলের প্রধান দরজা তৈরি করা হয়েছে।’’ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি হেমন্ত রজক বলেন, ‘‘জেলায় একেবারে প্রথম সারিতে যে ক’টি স্কুল রয়েছে, লাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় তার মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য স্কুল এ ভাবে এগিয়ে এলে জেলার ছবি পাল্টে যাবে।’’

সিন্দরি পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘এই পঞ্চায়েত এলাকায় লাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রকৃত অর্থে বিদ্যামন্দির হয়ে উঠেছে। আশ্রম ও মন্দিরের মিশেলে শিক্ষায় ভারতীয় সংস্কৃতির ধারা বহন করে চলেছে। তাই এই স্কুলই সবার কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education School Laka Barabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE