Advertisement
১১ মে ২০২৪

মাছ-মাংস ফেলে কাড়ান ছাতুতে মজেছে বিষ্ণুপুর

রামানন্দ কলেজের ইংরেজির শিক্ষক নরেন্দ্ররঞ্জন মালসের বাজারের থলিতেও উকি মারছিল ছাতু। তিনি বলেন, ‘‘পাঁঠার মাংস ৪৪০ টাকা, মুরগি ১২০ টাকা। কিন্তু সে সব তো সারা বছরই পাব। আজ তাই পাঁচশো ছাতুই নিলাম।’’

বিকিকিনি: রবীন্দ্র স্ট্যাচু মোড়ে সোমবার। নিজস্ব চিত্র

বিকিকিনি: রবীন্দ্র স্ট্যাচু মোড়ে সোমবার। নিজস্ব চিত্র

শুভ্র মিত্র
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৫৬
Share: Save:

লালমোহনবাবু দেখলে বলতেন, ‘‘সেলিং লাইক হট কচুরিজ।’’

বিষ্ণুপুরের বাজারে এখন কাড়াকা়ড়ি চলছে কাড়ান ছাতু নিয়ে। দাম? প্রায় ৬০০ টাকা কিলোগ্রাম। ‘‘হবে না-ই বা কেন?’’, সোমবার চকবাজারে ছাতু বাছতে বাছতে বলছিলেন মাধবগঞ্জের বিদিশা বসু, বৈলাপাড়ার আলিশা মণ্ডলরা— ‘‘কাঁচা লঙ্কা চিরে, পেঁয়াজ কুচি আর সরষে বাটা দিয়ে মেখে দশ মিনিটেই তৈরি। পাতে সাজিয়ে দিলে কোফতা, বিরিয়ানিকেও বলবে, ‘চুপ করে বসো দেখি খোকা!’ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি কাড়ান ছাতুর জন্য।’’

রামানন্দ কলেজের ইংরেজির শিক্ষক নরেন্দ্ররঞ্জন মালসের বাজারের থলিতেও উকি মারছিল ছাতু। তিনি বলেন, ‘‘পাঁঠার মাংস ৪৪০ টাকা, মুরগি ১২০ টাকা। কিন্তু সে সব তো সারা বছরই পাব। আজ তাই পাঁচশো ছাতুই নিলাম।’’

শরতের এই সময়টাতেই জঙ্গলে মেলে কাড়ান বা দুর্গা ছাতু। জীতাষ্টমীর সময় থেকে খাওয়া শুরু হয়। ধুম পড়ে দুর্গা পুজোর অষ্টমী থেকে ত্রয়োদশী পর্যন্ত।

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান সুব্রত রাহা জানান, মূলত লাল মাটিতে গাছের ছায়ায় এই ছাতু জন্মায়। শরতের শেষের আবহাওয়াতেই ছাতুটা হয়। এতে প্রচুর প্রোটিন থাকে। তিনি বলেন, ‘‘অন্য ছাতু চাষ করা গেলেও কাড়ান ছাতু চাষের উপায় এখনও হয়নি। চেষ্টা চলছে।’’

বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা, চিকিৎসক সুব্রত বিশ্বাস জানান, ঠিক মতো চিনে খেতে পারলে কাড়ান ছাতুতে কোনও ক্ষতি নেই। ভাল ভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে শুধু। তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেই তো কাড়ান ছাতুর জন্য অপেক্ষা করে থাকি সারা বছর।’’

বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কবিরাজপাড়ার চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত। ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করে আসছেন তিনি। বলেন, ‘‘এখনও মনে পড়ে, বাবা ধুতি পরে আমার হাত ধরে মনসাতলা বাজারে নিয়ে যেতেন। সেটা ১৯৪০ সাল। কাড়ান ছাতু ছিল ৫০ পয়সা কেজি।’’ এখন ছাতুর দাম শুনে একচোট বিষম খেলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। অবশ্য তার পরেই বললেন, ‘‘তা হোক। এ জিনিসের স্বাদই আলাদা। এই ক’টা দিন বিষ্ণুপুরের মানুষজন মাছ মাংসের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। শুধু গরম ভাত আর কাড়ান ছাতু।’’

বিষ্ণুপুরে আসা অনেক পর্যটকরাও কাড়ান ছাতু নিয়ে উন্মাদনার দৌ়ড়ে সামিল। হাতে ছাতু নিয়ে হোটেলে ফিরছিলেন বেলঘরিয়ার সুমনা আর অর্ণব। বললেন, ‘‘যেখানে এসেছি সেখানকার খাবার চেখে দেখব না, তা-ও কি হয়? কাল রাতে হোটেলের রাঁধুনি বলছিলেন, কাড়ান ছাতুর তরকারি খেলে নাকি সেটার টানেই আবার ফিরে আসতে হবে। শুনেই ঠিক করেছি, ব্যাপারটা চেখে দেখতে হবে।’’

কুড়ান ছাতুর প্রতি সবার এই টান দশমীর পরে মুখ আলো করেছে পূর্ণিমা, সুমিত্রাদের।

জঙ্গলঘেরা মোলকারি, নতুনগ্রাম, পানশিউলি, মানসা প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দা কালী লোহার, পূর্ণিমা লোহার, সুমিত্রা লোহাররা। তাঁরা বলেন, ‘‘সেই কোন ভোরে হাতি আর সাপ সামলে জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে ছাতু তুলে বাজারে নিয়ে এসেছি। পাতা আর শুকনো জ্বালানি কুড়িয়ে দিন চলে। কাড়ান ছাতু হল আমাদের পুজোর বোনাস।’’ পূর্ণিমা বলেন, ছেলেমেয়েগুলোকে পুজো পার করে হলেও একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারি এর জন্যই। বলতে পারেন, জঙ্গলই বাচ্চাগুলোর জন্য পুজোর উপহার পাঠায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chhatu বিষ্ণুপুর Bishnupur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE