Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলকে জমি দান এক কালের স্কুলছুটের

কোনও দিন কাজ জোটে, কোনও দিন জোটে না। ঘুপচি ঘরের সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ার বিন্দুইডির সেই দিনমজুর ঝুকা বাউ়ড়ি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলকে নিজের ৩ ডেসিমিল জমি দান করলেন।

জমির নথি প্রধান শিক্ষককে দিচ্ছেন ঝুকু বাউড়ি। নিজস্ব চিত্র

জমির নথি প্রধান শিক্ষককে দিচ্ছেন ঝুকু বাউড়ি। নিজস্ব চিত্র

শুভ্রপ্রকাশ  মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৮ ০১:৪১
Share: Save:

কোনও দিন কাজ জোটে, কোনও দিন জোটে না। ঘুপচি ঘরের সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ার বিন্দুইডির সেই দিনমজুর ঝুকা বাউ়ড়ি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলকে নিজের ৩ ডেসিমিল জমি দান করলেন। বিন্দুইডি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অনটনের জন্য পড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। ওই স্কুল থেকে প্রাথমিকের গণ্ডী পার করে পড়ায় ইতি টানতে হয়েছে তাঁর ছেলেকেও। কিন্তু আজও নিজের অভাব-অনটনের থেকে ঝুকার বেশি কষ্ট হয় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বাচ্চাগুলোকে মিড-ডে মিল খেতে দেখলে।

সোমবারই রঘুনাথপুরে গিয়ে জমি স্কুলের নামে করে দিয়েছেন ঝুকা। রেজিষ্ট্রি অফিসে বসে তিনি বলেন, ‘‘ফাঁকা জায়গায় বসে দুপুর রোদে বাচ্চাগুলো খাবার খায়। বৃষ্টি এলে থালা নিয়ে বারান্দায় ছোটে। দেখে খারাপ লাগত। আমরা দুপুরের খাবার পাইনি। এই বাচ্চাগুলো পাচ্ছে। স্কুলের পাশেই আমার জমি। যাতে ওরা একটু ভাল ভাবে খেতে পারে সেই ভেবে দিয়ে দিলাম।’’ বিন্দুইডি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমেন্দ্রনাথ মণ্ডল জানান, সেখানে ছাউনি দেওয়া মিড-ডে মিল খাওয়ার জায়গা তৈরি হবে। বাড়তি জমিতে হবে কিচেন গার্ডেন।

ওই স্কুলের সঙ্গে অবশ্য ঝুকার যোগ আরও আগে থেকে। বিন্দুইডি গ্রামের বাসিন্দা তাঁরই তিন আত্মীয়ের দেওয়া জমিতে গড়ে উঠেছে বিন্দুইডি প্রাথমিক স্কুল। সৌমেন্দ্রনাথ জানান, ১৯৬২ সালে বিন্দুইডি গ্রামে মাত্র এক ডেসিমিল সরকারি জমিতে তৈরি হয়েছিল স্কুলটি। সামান্য জায়গায় স্কুল চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরে মিতু বাউড়ি, লালমোহন বাউড়ি ও তারাপদ বাউড়ি তাঁদের ১২ ডেসিমিল জমি দান করেন। ২০১০ সালে ওই জমিতে গড়ে ওঠে স্কুলের নতুন বাড়ি। ঝুকা যখন স্কুলের জন্য জমি দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসেন, সবাই চমকে উঠেছিলেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করতে চাননি। সরকারি হিসেবেই ওই জমির দাম ৬৬ হাজার টাকা। আর বাজারদর তার থেকে অনেকটাই বেশি— লক্ষাধিক টাকা। এখন তাঁরাই মানছেন, বছর পঞ্চাশের ওই প্রৌঢ় অন্য ধাতুতে গড়া।

জমি তো পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে কী হবে? শিক্ষকরা যখন এই নিয়ে ভাবছেন, ঝুকাই প্রস্তাব দেন, মিড-ডে মিল খাওয়ার একটা জায়গা তৈরি করা হোক। এক কথায় রাজি হয়ে যান স্কুলের সবাই। জমি রেজিষ্ট্রেশনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় টাকা জোগাড়ের জন্য তদ্বির। প্রধান শিক্ষক জানান, ঝুকার সঙ্গে জমি দেওয়ার চুক্তি করে সেই নথি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দরবার শুরু করেছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত রাজ্যসভার এক সাংসদ ৫ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা নিজের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে বরাদ্দ করেন। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘বরাদ্দের ৬০ শতাংশ টাকা স্কুলের অ্যাকাউন্টে চলে এসেছে। জমিও পাওয়া গেল। এ বারে আমরা দরপত্র ডেকে দ্রুত কাজ শুরু করে দেব।”

নিতুড়িয়া ব্লকের বিন্দুইডি গ্রামের এই প্রাথমিক স্কুল অন্য ভাবেও কিছুটা ব্যতিক্রমী। গত বছর শিশুমিত্র পুরস্কার পেয়েছে এই স্কুল। পড়ুয়ারা এখানে শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকে না। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেই প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ক্রীড়ামন্ত্রী নির্বাচিত করে স্কুল পরিচালনার কাজে সক্রিয় ভাবে যুক্ত করা হয়। স্কুলের মিড-ডে মিল দেখার জন্য গ্রামের এক মহিলাকে ‘ভোজনমাতা’র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক সুব্রত শিট বলেন, ‘‘আমরা স্কুলটিকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাইছি। ডাইনিং শেড খুবই জরুরি ছিল। ঝুকাবাবুর এই সাহায্য গ্রামবাসী মনে রাখবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Daily Labour Land Donation School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE