বিষ্ণুপুরের রাসতলায় বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভ্র মিত্র
দোতলার ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। পাশের ঘরে তখন ঘুমাচ্ছিলেন বিটেক পাশ করা ছেলে। তাঁকে উদ্ধার করে আনার জন্য পড়শিদের কাছে কাকুতি-মিনতি করছিলেন মা-বাবা। ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া সরু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সেই ছেলেকে নীচে নামিয়ে আনলেন পড়শিরা। পাড়ারই আরও কয়েকজন বন্ধ ঘরের জানলার কাচ ভেঙে জল ঢেলে আগুন নেভানোর প্রাথমিক কাজও করলেন। তাঁদের তৎপরতায় বৃহস্পতিবার সকালে বড়সড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন বিষ্ণুপুরের রাসতলার ব্রহ্ম পরিবার।
বিষ্ণুপুরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রাসমঞ্চের পাশে রাসতলায় সঙ্গীত শিল্পী দম্পতি উদয়শঙ্কর ব্রহ্ম ও দীপা ব্রহ্মের বাড়ি। এ দিন সকাল সওয়া সাতটা নাগাদ ওই বাড়ির দোতলায় সিঁড়ির পাশের ঘরে আগুন লাগে। সেই সময় ওই দম্পতি নীচের তলায় ছিলেন। উপরে একটি ঘরে তখন ঘুমোচ্ছিলেন দম্পতির ছেলে শ্বৈত্যশঙ্কর ব্রহ্ম।
দীপাদেবী বলেন, ‘‘দোতলার ওই ঘরে সকালে ইমারশন প্লাগে জল গরম করেছিলাম। স্যুইচ বন্ধ করেই নীচে নেমে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পরে শুনতে পাই, আমাদের দোতলার আগুন লেগেছে বলে পাড়ার লোকেরা চিৎকার করছেন। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। পাড়ার অনেকে ততক্ষণে ছুটে এসেছেন। ওদের বলি, ওপরে যে ঘরে আগুন লেগেছে, তার পাশের ঘরেই আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ওকে বার করে আনার জন্য সবাইকে অনুরোধ করতে থাকি।’’
রাসতলার বাসিন্দা তপন দে, জগবন্ধু দে, নাড়ু মাঝিরা উপরে ওঠার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, ‘‘উপরে উঠব কী করে ভেবে পাচ্ছিলাম না। সরু সিড়ি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে প্লাস্টিক পোড়ার দুর্গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শ্বৈত্যকে নিয়ে আসতে গেলে ওই আগুন ধরে যাওয়া ঘরের পাশের বারান্দা পার করেই যেতে হত। এত ধোঁয়া যে সেখান দিয়ে যাওয়া যাবে কি না, ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারই মধ্যে কোনও রকমে দু’জনে ঝুঁকি নিয়ে উপরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে শ্বৈত্যশঙ্করকে বার করে নীচে নেমে আসে।’’
ততক্ষণে, আরও কিছু বাসিন্দা বাইরে থেকে বাঁশ দিয়ে উঠে আগুন লাগা ঘরের জানলার কাচ ভেঙে জল দেওয়া শুরু করেছিলেন। স্থানীয় কাউন্সিলর পিঙ্কি নামহাতা বিষ্ণুপুর দমকল কেন্দ্রে খবর দেন। মিনিট চল্লিশের মধ্যে পাড়ার ছেলেরা আগুন অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আনেন। দমকল কর্মীরা গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। সকলে মিলে এক ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
এ দিন বেলায় দোতলার ওই ঘরে দিয়ে দেখা যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পোড়া আসবাসপত্র। আগুনের তাপে গলে গিয়েছে স্যুইচ বোর্ড, ইলেকট্রিক তারের লাইনের পাইপ, ফাইবারের দরজা। দেওয়ালে কালো দাগ। বিছানা ও আলনায় রাখা পোশাক অনেকখানি পুড়ে গিয়েছে।
শ্বৈত্যশঙ্কর জানান, বিটেক পাশ করে তিনি চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বুধবার অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে তিনি ঘুমাতে গিয়েছিলেন। তাই পাশের ঘরে আগুন লাগলেও তিনি প্রথমে টের পাননি। তাঁর কথায়, ‘‘লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। তাঁদের কথায় বুঝতে পারি, পাশের ঘরে আগুন লেগেছে। কিন্তু, ওই নীচে নামতে গেলে ওই ঘর পার হতে হবে। ভয়ে তাই আর ঘর থেকে বার হতে পারিনি। পাড়ার লোকেরা না এলে কী হত ভাবলে বুক কেঁপে উঠছে।’’ উদয়শঙ্করবাবুও বলেন, ‘‘পড়শিদের জন্যই খুব জোর বেঁচে গিয়েছি।’’
তাঁদের প্রতিবেশী বৃদ্ধা কানন লোহার বলেন, ‘‘ওঁদের বাড়ি থেকে ধোঁয়া বার হতে দেখেই পাড়ার ছেলেদের ডাকি। আশপাশে খড়ের প্রচুর বাড়ি রয়েছে। সময়ে আগুন নেভানো না গেলে কী যে হত কে জানে!’’
বিষ্ণুপুর দমকল কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মইনুর আলি খান বলেন, ‘‘কাউন্সিলরের ফোন পাওয়ামাত্র কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছন। পাড়ার লোকেরাও আগুন নেভাতে খুব সাহায্য করেছেন।’’ তাঁর অনুমান, স্যুইচ বোর্ডে শট সার্কিট থেকেই আগুন ছড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেখান থেকে বিদ্যুৎবাহী তারের প্লাস্টিক কভারেও আগুন লেগেছিল। তা থেকেই আগুন ছড়িয়ে পরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy