নবকুমার সূত্রধর। নিজস্ব চিত্র
ফুল থেকেই তৈরি হয় রং। সেই রঙেই ফুটে উঠছে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, মহিষাসুর। পটে সেই ছবি ফুটিয়ে তুলছেন মহম্মদবাজারের রঘুনাথপুর গ্রামের নবকুমার সূত্রধর। পুজোর জন্য এখন পট আঁকায় ব্যস্ত নবকুমারবাবু। রঘুনাথপুরের সূত্রধর পরিবারের সদস্যরা সাত পুরুষ ধরে প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। গত বার দুর্গাপ্রতিমা বানিয়েছিলেন ৫৫টি। এ বারও ৫০এর বেশি প্রতিমা বানাচ্ছেন। প্রতিমার সঙ্গেই পট আঁকার কাজও করেন নবকুমারবাবু। প্রতি বছর তাঁর হাতেই রূপ পায় কড়িধ্যার চূড়মুড়া গ্রামের পট। নবকুমারবাবু বলেন, ‘‘সাত পুরুষ ধরে আমরা প্রতিমা তৈরি করে আসছি। দুর্গার পটও আঁকছি। তবে বাজারচলতি রাসায়নিক রঙে নয়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো এখনও আমরা ভেষজ রঙেই পট আঁকছি।’’
পটের কাঠামো তৈরি করে ভালোভাবে শুকিয়ে তারপর শুরু হয় আঁকার কাজ। পট আঁকতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় মাস ছয়েক আগে থেকেই। বিভিন্ন রঙের ফুল শুকিয়ে তার থেকে তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক রং। সূত্রধর পরিবার পটের জন্য নিজেরাই তৈরি করেন ভেষজ রং। বসন্ত কাল থেকে তাঁরা সংগ্রহ করতে থাকেন শিমুল, পলাশ, অপরাজিতা, জবার মতো ফুল।
নবকুমারবাবু জানান, ফুলগুলিকে সংগ্রহ করে কড়া রোদে শুকাতে হয়। তারপর সেগুলিকে হামানদিস্তায় গুঁড়ো করা হয়। এই ফুলের পাঁপড়ির গুঁড়োর সঙ্গে মেশানো হয় তেঁতুলের বীজের থেকে তৈরি আঠা। ওই আঠা তৈরি করতে হলে প্রথমেই তেঁতুলের বীজগুলোকে রোদে শুকাতে হয়। এরপর সেগুলোকে মুড়ি ভাজা খোলায় ভাজতে হয়। ভাজা হলে বীজের খোসা ছাড়াতে হয়। এরপর বীজের ভিতরের সাদা অংশ বেঁটে জলে সিদ্ধ করে আঠা তৈরি হয়। আঠার সঙ্গে শুকিয়ে রাখা ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো মিশিয়ে বানানো হয় ভেষজ রং।
নানা ফুল থেকে নানা রকম রং তৈরি হয়। পলাশ ফুল থেকে তৈরি হয় কমলা রং। শিমুল ও জবা থেকে লাল, অপরাজিতা থেকে নীল রঙ তৈরি হয়। হলুদ বেটে তার সঙ্গে আঠা মিশিয়ে বানানো হয় হলুদ রং। গাছের পাতা থেকে সবুজ। আর সাদা খড়িমাটি থেকে তৈরি হয় সাদা রঙ। এলামাটি থেকে হলুদ, বাদামি রঙ। মুড়ি ভাজার খোলার কালি, হ্যারিকেনের কালি থেকে তৈরি হয় চোখ আঁকার কালো রং। এই রঙ তৈরির পর শুরু হয় পটের চালিতে আঁকার কাজ।
পটের চালিতে তুলির টানে রূপ পেতে থাকে দেবীর। দশভূজা ফুটে ওঠেন পটের চালিতে। এই কাজে খাটনি অনেক। তবুও পারিশ্রমিকের কথা মনে না রেখে সৃষ্টির আনন্দে তুলি ধরেন নবকুমারবাবু। দিনরাত জেগে ফুটিয়ে তোলেন দেবীর রূপ। এ বছরও শুরু করে দিয়েছেন পট আঁকার কাজ। প্রতি বছরের মতো এবারও তার হাতের আঁকা দুর্গার পটে পুজো হবে কড়িধ্যা অঞ্চলের চূড়মুড়া গ্রামের রায় বাড়ির তিনশো বছরের প্রাচীন পুজোয়। শিল্পীর কথায়, ‘‘প্রাকৃতিক এই রং যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনই দীর্ঘদিন নষ্ট হয় না। এই রঙে কাজ করতে ভালো লাগে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy