ময়দানে মুখোমুখি। রবিবার বিকেলে হিজলি মাঠে প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।
পুরস্কারের টাকা যখন চাঁদা হিসাবে তোলা হয়েছিল, উদ্যোক্তারা তখন থোড়াই জানতেন, ৮ তারিখ রাত ৮টায় নরেন্দ্র মোদীর এক ‘বোমায়’ সব ঘেঁটে যাওয়ার উপক্রম হবে!
৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিলের সেই ঘোষণা শুনে কপালে তাই চিন্তার মস্ত ভাঁজ পড়েছিল পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের হিজলি ময়দানে ফি-বছর বড় মাপের ফুটবল প্রতিযোগিতার আসর বসানো স্থানীয় ষোলআনার কর্তাদের। প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ ফুটবলে পুরস্কার মূল্য হিসাবে টাকার অঙ্কটা যে নেহাত কম নয়! চ্যাম্পিয়নের জন্য নগদ ১ লক্ষ ২৫ হাজার এবং রানার্সের জন্য ১ লক্ষ টাকা। কী করবেন ভেবে আকুল কর্তারা হাজার মাথা চুলকেও কোনও উপায় বের করতে না পেরে ঠিক করলেন, পাঁচশো-হাজারই সই। আর পথ খোলা নেই। কারণ ব্যাঙ্কে জমা দিলেও এক দফায় দু’হাজারের বেশি সচল নোট মিলছে না।
খেলোয়াড়েরা অচল নোট নেবে তো, এই মর্মে আয়োজকদের মনে একটা ধুকপুকানি ছিল বটে। শেষ অবধি অবশ্য আশঙ্কার সেই মেঘ কেটেছে। রবিবার বিকেলে হিজলি মাঠে ফুটবল ফাইনাল শেষে হাজার হাজার দর্শকের মাঝে সেই বাতিল নোটেই বিজয়ী ও বিজিত দলের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন অতিথিরা। হাসিমুখে সেই পুরস্কার গ্রহণও করলেন ফুটবলারেরা।
স্থানীয় ষোলআনা পরিচালিত এই ফুটবল প্রতিযোগিতাটি এ বার পাঁচে পা দিল। এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে এলাকায় প্রচুর উৎসাহ। হুড়া লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষজনের কাছে রীতিমতো সম্মানের খেলার আসর। দর্শক ঠাসা মাঠে ফাইনালে মুখোমুখি হয় স্থানীয় বিএমএস ক্লাব ও সেনাপতি একাদশ। টাইব্রেকারে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় হুড়া বিএমএস ক্লাব।
আর্থিক পুরস্কারের পাশাপাশি ট্রফি পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স দল। সেমিফাইনালে ওঠা অন্য দুই দলকেও ৫০ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তাদের অন্যতম মজফ্ফর হোসেন বলেন, ‘‘আমরা চাঁদা তুলে পুরনো টাকা তুলেছিলাম। সেই টাকাই দিয়েছি। গ্রামীণ এলাকা বলে পুরস্কারের অর্থমূল্য আমাদের আগে থেকেই জোগাড় করতে হয়। হঠাৎ ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের কছু করার ছিল না। ওই নোটেই পুরস্কার মূল্য চোকাতে হয়েছে।’’ চ্যাম্পিয়ন দলের কর্মকর্তা বীরেন মুর্মুর কথায়, ‘‘খেলোয়াড়দের খাওয়াদাওয়ার টাকাও নগদ দিতে হবে। এই টাকাতেই দেব।’’
প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন বিএমএসের মানব টুডু। এ ছাড়াও সর্বোচ্চ গোলদাতা, সেরা গোলরক্ষ, আদর্শ খেলোয়াড়ের জন্য আর্থিক পুরস্কার ছিল। তাঁরাও অচল নোটেই পুরস্কার নিয়েছেন। মানবদের বক্তব্য, ‘‘একটু অসুবিধে হবে ঠিকই। তবে ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার এখনও অনেক সময় আছে। তা ছাড়া, এই সময়ে উদ্যোক্তারাই বা নতুন নোট পাবেন কোথায়?’’
রবিবার দিনভর ফাইনালের সঙ্গে আরও কয়েকটি ম্যাচের আনন্দ চুটিয়ে উপভোগ করেছেন দর্শকেরা। সকাল থেকেই দূরের ব্লকগুলি থেকে দলে দলে দর্শক হাজিরা দিয়েছিলেন মাঠে।
পুরুলিয়া ২ ব্লকের সিহলি-সহ আশপাশের গ্রামগুলি থেকে এসেছিলেন সন্তোষ সহিস, ভক্তিপদ মাহাতোদের মতো ফুটবল প্রেমীরা। গাড়ি ভাড়া করতে সমস্যা হয়েছে পাঁচশো-হাজার বাতিল হয়ে যাওয়ায়। তাঁদের গাড়ির চালক বীরবল মাহাতোর কথায়, ‘‘অনেক দিন আগে থেকে এঁরা বলে রেখেছিলেন। জানি পাঁচশো-হাজার নিয়ে সমস্যা পড়ব। তবু মাঠে গিয়েছি। তা ছাড়া নিজেও খেলা দেখলাম।’’
তবে, এই প্রতিযোগিতার সৌজন্যে যাঁদের দু’পয়সা রোজগার হয়, তাঁদের ব্যবসা মার খেয়েছে। মাঠে দু’দিন ধরে প্রচণ্ড ভিড় হওয়ায় নানা স্টল বসে সেখানে। স্ন্যাক্সের দোকান দিয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে অজিত গরাঁইকে। বলছিলেন, ‘‘সবাই পাঁচশো টাকার নোট দিতে চায়। কোথায় এত খুচরো পাব? অগত্যা বিক্রিবাটা বন্ধ রাখতে হয়েছে।’’ গতবার কলা বেচে বেশ লাভের মুখ দেখেছিলেন কৃষ্ণপদ গরাঁই। এ বার অন্য ছবি। চা-তেলেভাজার দোকানদার তুলসী মুদিও বললেন, ‘‘নোট বাতিলের চক্করে বড্ড ক্ষতি হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy