রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এভাবেই বাজার বসে। ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।
মাথার উপর ছাদ নেই। সাইকেল বা বাইক রাখার স্ট্যান্ড নেই। শৌচাগার নেই। মাল ওঠা, নামা করার জন্য গাড়ি রাখার জায়গা নেই। নেই, কোনও স্থায়ী বাজারের জায়গাও। তবু রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে, খোলা আকাশের নীচে খদ্দেরদের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয়। বছরের পর বছর পাড়ুই ধর্মতলার বাজারে এ ভাবেই এত কিছু ‘নেই’-এর মধ্যেও চলছে কয়েকটি গ্রামের হাজার মানুষের রুজি-রুটির বিকিকিনি!
বোলপুর-সিউড়ি মুখ্য রাস্তার উপরে পাড়ুই বাসস্টপ। বাসস্টপ থেকে চার পা এগোলেই পাড়ুই সুপার মার্কেট আর ধর্মতলা বাজার এলাকা। রাস্তার প্রায় গা ঘেঁষে পঞ্চায়েতের দেওয়া জায়গায়, দোকান ও পসরা সাজিয়ে বসেন এলাকার দুশো ব্যবসায়ী। পাড়ুই লাগোয়া দিঘা গ্রামের বাসিন্দা, ওই বাজারের মনোহারী দ্রব্য বিক্রেতা ইসরাইল পটুয়া। গত তিন দশকের কিছু বেশি দিন ধরে এই বাজারে পসরা সাজিয়ে বসেন। তিনি বলেন, “সাপ্তাহিক সোমবার এবং শুক্রবার দু’ দিনের জন্য এই হাট বসে, পঞ্চায়েতের ওই জমিতে। জায়গা এত ছোট, দিন কয়েক আগে স্থানীয় শাহাপুরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রায়, মারধরের উপক্রম হয় পাশের গ্রামের এক ব্যবসায়ীর। ঝামেলা গণ্ডগোল এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যে এক তাঁকে একেবারে পাড়ুই হাটতলা বাজার এলাকা ছাড়তে হয়েছে।”
ইসরাইলের পাশেই ব্যবসা করেন নিতুড়ি গ্রামের বাসিন্দা সুকুমার ডোম। তিনি বলেন, “পাড়ুই বাজারের কেনাবেচার টাকায় সংসার চলে। কিন্তু রাস্তার ওপর দুটি বড় গাড়ি একে অপরকে ওভারটেক করুক অথবা পাশাপাশি যাক, যানজটে বাজার লাটে ওঠার যোগাড়! প্রায় গায়ের ওপর দিয়ে এক রকমের যেতে হয় ওই গাড়ি চালকদের।” পরিস্থিতি এমনই, যানজটের ডামাডোলে, দোকানের জিনিষও গড়িয়ে যায় রাস্তায়। ওই হাটতলা এলাকার সব্জি বিক্রেতা শেখ হোসেন, শ্রীরামপুরের সব্জি বিক্রেতা শেখ রহমানরা জানান, স্থানাভাবের জন্য এক ব্যবসায়ীর মাল অন্যের দোকানের দিকে কখনও সখন গড়িয়ে যায়। তাতে ক্রেতাদেরও অসুবিধা হয়।
এখানেই শেষ নয়। সদা ব্যস্ত বোলপুর-সিউড়ি মুখ্য সড়কের গা ঘেঁষে এই বাজারে, জায়গার অভাবে হাইটেনশন তারের তলায় ব্যবসা করেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের গাড়ি-সাইকেল পারকিং করার জায়গা না থাকায় যানজট ও দুর্ঘটনা পাড়ুই বাজার এলাকায় একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমন একটি ঘটনার কথা বলছিলেন ব্যবসায়ী মনজিত ঘোষ। তিনি বলেন, “মাস খানেক আগের কথা। অল্পের জন্য এক বৃদ্ধার প্রাণ রক্ষা হল। বাইক দাঁড় করিয়ে পুরন্দরপুরের বাসিন্দা স্বপন মালাকার বাজার-হাট সারছিলেন আর পাঁচটা দিনের মত। বাইকের পাশেই মাটিতে বসে ভোলাগড়িয়ার এক বৃদ্ধা রাসমনি দাস সব্জি কেনাকাটা করছিলেন। আচমকা বাইক পড়ল বৃদ্ধার গায়ে। এমন পড়ল, যে বৃদ্ধা একেবারে অচৈতন্য। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সে যাত্রা বেঁচে গেলেন, কিন্তু বাকি জীবনের জন্য, উনি নিজের পা খোয়ালেন।” মনজিত্বাবুর ক্ষোভ, “যদি একটি সাইকেল বা গাড়ি পারকিং করার জন্য জায়গা থাকত, তাহলে অশীতিপর ওই বৃদ্ধা আজকে এই অসুবিধের মুখোমুখি হতেন না।”
বাজারের মাথার ওপর হাইটেনশন বিদ্যুতের তার। রাস্তার ধারে ওষুধের দোকানের পাশেই রয়েছে বড় ট্রান্সফরমার। ঝুঁকি নিয়ে তারই নীচে বসে বিকিকিনি করছেন তপন ডোম। নিজের পাঁচ কাটা জমিতে টমেটো, সসা লাগিয়েছেন স্থানীয় দেবগ্রামের ক্ষুদ্রচাষি তপন। তাঁরই মতো কাটা ছয়েক জমিতে বেগুন, টমেটো ফলিয়েছেন দেসাইপুরের প্রান্তিক চাষি শেখ মোজাম্মেল হক। কুন্দরার বাসিন্দা পার্থ অধিকারী ছোলা, টমেটো, বেগুন-ফুলকপি নিয়ে বসেছেন তাঁদের পাশে। বলছিলেন, “একটু অন্য মনস্ক হলেই, পাশের ট্রান্সফরমার থেকে অহরহ বিদ্যুতের ফুলঝুরি পড়ে। কিন্তু কোথায় আর যাব, বাজারে না বসলে সংসার চালাব কি করে!”
ফল, শাকসব্জি বাজার, নটকোনা দোকান, বালিশ-তোষকের পসরা, লেদ ও হার্ডওয়্যারের দোকান, তার গা ঘেঁষেই মাছের বাজার। মাছ ধোওয়ার জল গড়িয়ে যাচ্ছে, ফলের দোকানের ভিতর দিকে। তাতে চটছেন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই। কখনও সখনও সেই ক্ষোভ ঝগড়াতেও গিয়ে ঠেকে। তাঁদের ক্ষোভ, শাক-সব্জি বাজারের কাছে মাছের বাজারের জন্য আলাদা যদি একটু জায়গা দেওয়া হয়, তাতে ক্ষতি কোথায়? তাহলে তো নিত্য ভোগান্তি আর হয় না। পেশায় মাছ ব্যবসায়ী, পাড়ুইয়ের বাসিন্দা রঘুনাথ হাজরা, বনমালী দাস, দেবগ্রামের বাসিন্দা সুনীল হালদাররা বলেন, “স্থানীয় মানুষ এই বাজারের ওপর নির্ভরশীল। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে, মাছ বাজারকে গড়ে তুললে ক্রেতা বিক্রেতা সকলের ভাল হয়।” এত সমস্যা নিয়েই বসে পাড়ুইয়ের হাট-বাজার। খবরের শিরোনামে নিত্য পাড়ুইয়ের নাম উঠে এলেও, এলাকার উন্নয়ন নিয়ে হোলদোল নেই কোনও রাজনৈতিক দলেরই। অথচ, এই পাড়ুইয়ের উপর দিয়েই জেলার সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের যাতায়াত। কার্যত পথের ডামাডোলেই চৌপাট এ বাজারের সুষ্ঠ বিকিকিনির ছবি।
পাড়ুই বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুস্তাক হোসেন বলেন, “বাম জমানায় ওই সুপার মার্কেট কার্যত জতুগৃহ ছিল। দল ক্ষমতায় আসার পরেই, স্থানীয় বাসিন্দাদের (ক্রেতা-বিক্রেতা) সুবিধার জন্য, প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে সুপার মার্কেট-এ। এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের মার্কেটের ঘরগুলি দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েতের কাছে থেকে জায়গা নিয়ে আপাতত একটি বাজার করা হয়েছে।”
তাঁর দাবি, ভবিষ্যতে ওই সুপার মার্কেটটির দোতলা করার পরিকল্পনা রয়েছে। শাক,সব্জি বাজার এবং হাট নিয়েও সমসার কথা মাথায়ে রেখে, দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রয়েছে উপযুক্ত পরিকল্পনা মাফিক একটি বাজারের প্রস্তাবও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy