Advertisement
১১ মে ২০২৪

১৪ বা ২০ নয়, আলুর দর ১৭ টাকা

মুখ্যমন্ত্রীর সাফ ঘোষণা, খোলা বাজারে আলুর দাম কেজিতে ১৪ টাকা ছাড়াবে না। অথচ বাজারে সেই আলুই বিকোচ্ছে ২০-২২ টাকা দরে। এই অবস্থায় ‘মধ্যপন্থা’ নিল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। বাস্তব অর্থনীতির দিকে তাকিয়েই আলু ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে বাঁকুড়ার খোলা বাজারে আলুর সর্বোচ্চ দাম ১৭ টাকা পর্যন্ত ছাড় দিল জেলা প্রশাসন। অর্থাৎ, ১৪ নয়, আবার এক লাফে ২০ টাকাও নয়।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০১:০৫
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর সাফ ঘোষণা, খোলা বাজারে আলুর দাম কেজিতে ১৪ টাকা ছাড়াবে না। অথচ বাজারে সেই আলুই বিকোচ্ছে ২০-২২ টাকা দরে।

এই অবস্থায় ‘মধ্যপন্থা’ নিল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। বাস্তব অর্থনীতির দিকে তাকিয়েই আলু ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে বাঁকুড়ার খোলা বাজারে আলুর সর্বোচ্চ দাম ১৭ টাকা পর্যন্ত ছাড় দিল জেলা প্রশাসন। অর্থাৎ, ১৪ নয়, আবার এক লাফে ২০ টাকাও নয়।

মুখ্যমন্ত্রী ১৪ টাকায় দর বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও কেন এই সিদ্ধান্ত?

রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের পরিষদীয় সচিব তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ এবং জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর যুক্তি, ‘‘আলুর সর্বোচ্চ দাম ১৪ টাকা করার জন্য সরকার থেকে কোনও নির্দেশিকা আসেনি।” মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাই কি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়? প্রত্যাশিত ভাবেই এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।

জেলার খোলা বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে বুধবার হিমঘর মালিকদের সংগঠন এবং প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতিকে নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করেছিল জেলা প্রশাসন। দুই ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেলাশাসক বিজয় ভারতী, অরূপ খাঁ, অরূপ চক্রবর্তী-সহ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। জেলার বাজারে জ্যোতি আলুর দাম এখন কেজি প্রতি ২০ টাকা। প্রশাসনিক বৈঠকে ব্যবসায়ীদের বলা হয়, খোলা বাজারে যাতে ১৪ টাকার বেশি আলুর দর না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু, ব্যবসায়ীরা জানিয়ে দেন, তাঁরা সাড়ে ১৫ টাকার নীচে আলু আড়তদারদের বিক্রি করতে পারবেন না। আর তা হলে খোলা বাজারে আলুর দাম অন্তত ১৭ টাকা প্রতি কেজি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই দরই ঠিক হয়।

এ দিনের বৈঠকেই ঠিক হয়েছে, আলু ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের ১৫.৫০ টাকা মূল্যে আলু বিক্রি করবেন। আড়তদারেরা কেজিতে আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে খুচরো ব্যবসায়ীদের বিক্রি করবেন ১৬ টাকা দরে। আর খুচরো বিক্রেতারা ১৬ টাকায় আলু কিনে প্রতি কেজিতে ১ টাকা লাভ রেখে ক্রেতাদের ১৭ টাকা মূল্যে আলু বিক্রি করবেন। এ ছাড়া, প্রতিটি হিমঘরে একটি করে বিশেষ কাউন্টার খুলে সেখান থেকে জেলার খুচরো ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতাকে ১৬ টাকা মূল্যেই আলু বিক্রি করতে হবে বলে নির্দেশ দেন জেলাশাসক। যদিও ঘটনা হল, জেলার মেজিয়া, বড়জোড়া, সারেঙ্গার মতো বেশ কিছু ব্লকে কোনও হিমঘর না থাকায় আড়তদারদের কাছ থেকে আলু কেনা ছাড়া খুচরো ব্যবসায়ীদের গতি নেই।

হিমঘর মালিক সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিরা আলুর সর্বোচ্চ মূল্য ১৭ টাকা করতে বললেও এই সিদ্ধান্তে মাথায় হাত পড়েছে খুচরো ব্যবসায়ীদের। তাঁদের অভিমত, কেজিতে ১ টাকা লাভ রেখে আলু বিক্রি করলে তাঁদের আখেরে লাভ বলে কিছুই থাকবে না। এর কারণ হিসেবে খুচরো বিক্রেতাদের যুক্তি, তাঁরা বাছাই করে আলু কেনার সুযোগ না পেলেও ক্রেতাদের সেই সুযোগ দিতে হয়। আলুর প্রতিটি প্যাকেটে (৫০ কেজির এক-একটি প্যাকেট) অন্তত দু’কিলো আলু এমনিতেই ফেলা যায়। তার উপরে আড়তদারদের কাছ থেকে আলু আনা বাবদ পরিবহণ খরচ রয়েছে। গত বছর সরকারি মূল্যে আলু বিক্রির জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল খুচরো বিক্রেতাদের। সরকারের নির্দেশ মানতে গিয়ে ক্রেতাদের আলু বাছাইয়ের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন খুচরো বিক্রেতারা। বাছাই করা আলু কিনতে গেলে সরকারি মূল্যের চেয়ে ১ টাকা বেশি দরে কিনতে হত ক্রেতাদের। গত বছর বাঁকুড়ার প্রায় সব বাজারেই এই চিত্র দেখা গিয়েছে।

সেই একই ছবি কি আবার ফিরে আসতে চলেছে? খুচরো ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, “আলুর দাম কেজি প্রতি অন্তত ১৮ টাকা হলে আমরা কিছুটা লাভ পেতাম। কিন্তু, তা না হওয়ায় বাধ্য হয়েই বাছাই করে আলু কিনতে গেলে দাম বাড়াতে হবে আমাদের।”পাশাপাশি তাঁদের আরও ক্ষোভ, সব জায়গা তো হিমঘরই নেই। তা হলে ১৬ টাকায় আলু কেনার জন্য অতটা পথ উজিয়ে হিমঘরের বিশেষ কাউন্টার অবধি ক’জন খুচরো বিক্রেতাই বা যাবেন? পাশাপাশি, সাধারণ ক্রেতারাই বা কেন সামান্য দু-চার কেজি আলুর জন্য হিমঘর পর্যন্ত যাবেন, সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। খুচরো ব্যবসায়ীদের বাস্তব সমস্যা শোনার অবশ্য সুযোগ হয়নি প্রশাসনিক কর্তাদের। কারণ, তাঁদের প্রতিনিধিদের ডাকাই হয়নি এ দিনের বৈঠকে। জেলা সভাধিপতির অবশ্য দাবি, “১৬ টাকায় আলু কিনে ১৭ টাকায় বিক্রি করলে লোকসানের সম্ভাবনা নেই খুচরো বিক্রেতাদের। বাজারে এর বেশি দাম আমরা উঠতে দেব না।”

এ দিকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্ধারিত দামের বেশি মূল্যে আলু বিক্রিতে জেলা প্রশাসন ছাড়পত্র দেওয়ায় নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। জেলাশাসক বিজয় ভারতীর বক্তব্য, “খোলা বাজারে আলুর মূল্য এই বৈঠকে নির্ধারণ করাই হয়নি। আমি শুধু হিমঘরের সামনে কাউন্টার খুলে খুচরো বিক্রেতাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পাইকারি রেটে আলু বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছি। তা ছাড়া, ১৪ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করতে হবে বলে কোনও নির্দেশিকাও আমরা পাইনি।”

আবার অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, আলু ব্যবসায়ীরাই ১৭ টাকা দর ঠিক করেছেন। এতে প্রশাসনের কোনও ভূমিকা নেই। পরিষদীয় সচিব অরূপ খাঁ বলেন, “আলুর মূল্য আমরা ধীরে ধীরে কমানো শুরু করেছি। আপাতত ১৭ টাকায় বিক্রি করা হোক। ধীরে ধীরে ১৪ টাকা মূল্যেও আলু বিক্রি হবে। প্রশাসন স্টল খুলে তখন ওই মূল্যে আলু বিক্রি করবে।” সভাধিপতি জানান, বাঁকুড়া জেলায় রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৪ টাকা মূল্যে বিপিএল মানুষদের আলু বিক্রি করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু কবে থেকে তা শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারেননি।

দাম নির্ধারণে প্রশাসনের ভূমিকা নেই বলে দাবি করা হলেও প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির জেলা সম্পাদক বিভাস দে বলেছেন, “জেলা প্রশাসনই খোলা বাজারে আলুর দাম ১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। তার জন্য আমাদের সাড়ে ১৫ টাকা মূল্যে আড়তদারদের এবং হিমঘরে কাউন্টার করে ১৬ টাকায় খুচরো ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে আলু বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছে। আমরা সেই নির্দেশ মেনে চলব।” তবে এটা যে স্থায়ী সমাধান নয়, তা মেনে নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “খুচরো বিক্রেতাদের তরফে কেউ এ দিনের বৈঠকে ছিলেন না। বাজারে আলুর দাম কত হওয়া উচিত, তা ঠিক করতে খুচরো বিক্রেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক করার আর্জি জেলা প্রশাসনের কাছে জানিয়েছি।”

আলু নিয়ে চাপানউতোর চলবেই। কিন্তু, বাজারে গিয়ে সাধারণ ক্রেতা ২০ টাকার কমে আলু আদৌ পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় যথেষ্ট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajdwip bandyopadhyay bankura potato price hike
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE