ছেলের বাবাদের এমন দুর্দিন বোধহয় আগে কখনও আসেনি। বছর কুড়ি আগে পর্যন্তও পুত্রসন্তান লাভের গর্বে আটখানা তাঁরা মেয়ের বাবাদের দিকে তেরছা চাউনি ছুড়ে বিয়ের ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে শুরু করতেন। সোনার আংটির মালিকানা তাঁদের হাতে। সে আংটি বাঁকা, চ্যাপ্টা, টাল খাওয়া যা খুশি হোক, ও সব নিয়ে ভাবে কে? ছেলের বাড়ির তখন একটাই কাজ। তাক বুঝে আংটিখানা পাতে ফেলা। শুকনো-মুখো, কাঁচুমাচু মেয়ের বাবাদের হ্যাংলামি তখন স্রেফ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার ব্যাপার। ছেলের শুধু একখানা পাকা চাকরি। সরকারি হলে, তোফা। নিজের বাড়ি, দর আর একটু বাড়বে। একমাত্র ছেলে, সুপুরুষ, বয়স অল্প, নিজের গাড়ি... লিস্ট যত লম্বা হবে, মেয়েপক্ষের গদগদ ভাব আর হাত কচলানি তত বাড়বে। গড়পড়তা এই তো ছিল ছবি।
তার পর দিনকাল বদলে গেল। আইটি-র রমরমা হল। দেশে ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল। চাকরি পেয়ে বিদেশে পা রাখা গোয়া বেড়িয়ে আসার মতোই মধ্যবিত্ত বাঙালির নাগালের মধ্যে চলে এল। আর কখন যেন সেই ফাঁকতালে টুক করে পাশা পালটে গেল। অন্তত, এ দেশের বিয়ের দুনিয়ায়। ছেলে জন্মালেই বাপ-মায়ের এখন বুক দুরদুর। সামনে দায়িত্বের হিমালয়। ছেলেকে তুখড় রেজাল্ট করাতেই হবে, ধারধোর করে হলেও এমবিএ পড়াতেই হবে, তার পর বিদেশের টিকিট হাতে তাকে এয়ারপোর্ট অবধি ঠেলে দুগ্গা দুগ্গা। ছেলে জাতে উঠল।
মেয়ের বাপ-মা বরং সে দিক থেকে অনেক ঝাড়া হাত-পা। এ কালে মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা কম। অন্তত শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে। ওর ঝুলিতে ডাক্তার পাত্র তো কী হয়েছে, আমার নাগালে আইটি আছে। দুবাইয়ের সম্বন্ধ ভেস্তে গেলেও পরোয়া নেই, কানাডা তো আছে। মেয়ে মানুষ করতেও হ্যাপা কম। সে খেটেখুটে বিদেশ গেল কি না, সে নিয়ে টেনশনে নখ খাওয়া নেই। তার স্যালারি ‘হাই ফাইভ ফিগার’-এ পৌঁছল কি না, তা নিয়ে জ্যোতিষ ঘাঁটা, মন্দিরে মাথা ঠোকা নেই। ভাল পড়াশোনা, সম্ভব হলে একটা ঝকঝকে চাকরি... ব্যস। ভারতে সম্বন্ধ করে বিয়ে-দুনিয়া, এই ২০১৬ সালে বসেও, তার কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করে না। ‘দুর্দান্ত’, ‘অসাধারণ’ বিশেষণগুলো সেখানে টুকটুক করে মেয়ের বাইরের রূপটার সঙ্গে জুড়ে গেলেই সবচেয়ে ভাল। কেরিয়ারের আগে বসলেও তাতে বিরাট কিছু যায়-আসে না।
বড় আজব এ দুনিয়া। এখানে চুম্বকের জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে স্যালারির সংখ্যা, বিলিতি ঠিকানা আর অবশ্যই হরোস্কোপ। বাদবাকি সমস্ত, এমনকী প্রেম-ভালবাসাও তুমুল চুম্বক টানে এদের গায়ে ধাক্কা মেরে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ব়ড়লোকের ঝকঝকে সুন্দরী মেয়েরা স্রেফ ভালবাসার হাতছানিতে সব কিছু ছেড়ে আদর্শকে পুঁজি করে টালির চালের নীচে সংসার পাতছে— এ সব দৃশ্য বোধহয় এখন ছোট-বড় পরদাদের গায়েই ফুটে ওঠে। সপ্তাহান্তে ইটিং আউট নেই, লং ড্রাইভ নেই, টুবিএইচকে-থ্রিবিএইচকে’র গপ্পো নেই, এক-দু’বছর অন্তর অনসাইট নেই, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিলিতি-বরফ খেলার ছবি নেই— তবে আর বিয়ে কীসের? পুরো জীবনটাই তো একটা আস্ত যশরাজ ফিলম্স-এর সেট। চোখ-ঝলসানো প্রাচুর্য আর পারিপাট্যে মাখামাখি। সেখানে দুঃখরাও আসে হেলিকপ্টারে চড়ে। সুতরাং সেই সিংহদরজার চাবিটিকে নিজের মেয়ের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে মেয়ের বাবারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। একই যুক্তি বলে, পালটাতে থাকা অর্থনীতির সঙ্গে দ্রুত তাল মেলাতে না পারলে এ যুগে ছেলের পরিবারের দুরবস্থার সূচক তরতরিয়ে উপরে উঠবে।
তবে, বিয়ে নিয়ে এমন তেতো অভিজ্ঞতার খপ্পরে পড়ার কথা ছিল না ‘আইটি প্রফেশনাল’ পরশুরামনের পরিবারের। তারা বরং ব্যস্ত ছিল কী করে সেরার সেরা পাত্রীটিকে বেছে নেওয়া যায়। কারণ, পরশুরামন ২৭, সুদর্শন, হিন্দু ব্রাহ্মণ, তার ওপর আবার কানাডার এক নামী কোম্পানিতে বছরে ৭০,০০০ ডলারের চাকরি করে। আশ্চর্য, সেই বিচ্ছিরি ঘটনাগুলো কিন্তু কিছুতেই এড়ানো গেল না। কারণ, কন্যাপক্ষের কাছে ‘সুযোগ্য পাত্র’ হওয়ার মাপকাঠি বিস্তর বদলেছে। সে মাপকাঠিতে পরশুরামনের বেতন মোটেই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া, কানাডা? লন্ডন বা ওয়াশিংটন ডি.সি তো নয়। পরশুরামনের এই বিয়ে-ব্যবস্থা, প্রেম আর মন্দার বাজারে তার চাকরিজীবন নিয়ে এক জমজমাট গল্প লিখেছেন বাণী: ‘দ্য রিসেশন গ্রুম’ (জুফিক বুক্স)। বইয়ের পাতায় আটকে আছে ছেলের বিয়ে নিয়ে ছাপ মারা ভারতীয় মানসিকতা। বাণী অবশ্য একটা সাড়ে তিন ঘণ্টার সম্পূর্ণ ফ্যামিলি ড্রামা দু’মলাটের মধ্যে হাজির করতে চেয়েছেন। ফলে পড়তে গিয়ে পেপারব্যাক-এ বলিউড-দর্শন মনে হয়। গল্পের নাম ‘রিসেশন গ্রুম’ হলেও পাত্রের জীবনে রিসেশন আর ছাঁটাই এসেছে একটা অধ্যায়ের মতো। মন্দার বাজারে চাকরি হারানো আর ফিরে পাওয়ার মধ্যে যে প্রচণ্ড লড়াই, আর টেনশন থাকে, এই বইয়ে তার সামান্য খুদকুঁড়োটুকু আছে, কিন্তু তার বেশি নয়।
কিন্তু ছেলের বিয়ে নিয়ে এ দেশের পরিবারগুলোতে যে ধরনের চরম আদিখ্যেতা চলে, সেটা এই বইয়ের কাহিনি এবং নানান চরিত্র বেশ মনে পড়িয়ে দেয়। যেমন পার্বতী আন্টি। যেমন পরশুরামনের দিদি রাগিনী। এরা প্রত্যেকেই পরশুরামনকে সুখী দেখতে চায়। এবং সেই প্রয়োজন মেটাতে বসে এমন এক সম্বন্ধ নিয়ে আসে, যে পাত্রীর নামটুকুও পরশুরামন উচ্চারণ করতে পারে না। সেই সুখের বিয়ে সন্ধানেই তারা ছেলেকে প্রায় মেয়ের বাবার হাতের পুতুল বানানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলে। পরশুরামনও একেবারে এদেশীয় ‘সুপুত্তুর’। যে প্রতিবাদ করে, কিন্তু তাকে ধোপে টেকাতে জানে না। নিজের ভালবাসা চিনতে তার গোটা বই সময় লাগে। প্রতাপশালী উচ্চবিত্ত কন্যাপক্ষের সামনে পার্বতী আন্টির অসহ্য গদগদ ভাব, ভাইয়ের পোশাক বেছে দেওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে রাগিনীর অতিরিক্ত খবরদারি— এ সব কিছুই আমাদের খুব চেনা, কাছের মানুষদের ছায়ামাত্র।
আসলে, সম্বন্ধ করে বিয়েকে ঘিরে যে জগৎটা ঘোরে, সেটা একটা আস্ত বাজার। সেখানে পাত্র-পাত্রীর মতো পণ্য আছে, তাদের চোখধাঁধানো প্যাকেজিং আছে, দাম আছে, ক্রেতাকে টানার হরেক কৌশলও আছে। এমনকী সে পণ্যদের এক্সপায়ারি ডেটও আছে। কিন্তু চমৎকার একটা সামাজিকতা, লৌকিকতার রঙিন মোড়কে সে বাজারকে লুকিয়ে রাখা হয়। বাণী তার গল্পের মধ্যে দিয়ে, হয়তো বা অজান্তেই, সে বাজারকে বেআব্রু করে দিয়েছেন। এটার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy