রবীন্দ্রনাথ যখন ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’ ইত্যাদি লিখিয়াছিলেন, রূপকার্থেই লিখিয়াছিলেন, বায়ুদূষণের কথা ভাবেন নাই। রবীন্দ্রনাথের কাল দূরে থাকুক, মাত্র কয়েক দশক আগেও বায়ুদূষণ বলিলে কারখানার চিমনি বা রাসায়নিক পণ্য ও বর্জ্য, বাড়ির উনান, আবর্জনার স্তূপ ইত্যাদি হইতে নির্গত কুবাতাসের কথাই মানুষ বুঝিত। মানুষের চেতনায় সেই কুবাতাস ছিল স্থানীয় সমস্যা। স্থানটি ক্ষেত্রবিশেষে বড় হইতে পারিত, বড় কলকারখানার ক্ষেত্রে দূষণের প্রকোপ হয়তো অনেক দূর অবধি বিস্তীর্ণ হইত, কিন্তু তাহাও চরিত্রে স্থানীয়তার সীমা অতিক্রম করিত না। বায়ুদূষণ যে সমগ্র পৃথিবীর এক সাধারণ ও মূলত অভিন্ন সমস্যা হইতে পারে, এই বোধ আসিয়াছে গত শতাব্দীর শেষ ভাগে। দূষণ যত বাড়িয়াছে, সেই বোধও ততই জোরদার হইতেছে। বায়ুদূষণের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ চলিতেছে পূর্ণোদ্যমে। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ নামক বার্ষিক রিপোর্টটি সেই সব উদ্যোগের অন্যতম। সম্প্রতি রিপোর্টের ২০১৯ সংস্করণ প্রকাশিত। ২০১৭’র পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর আছে এই সংস্করণে। সেই খবর শ্বাসরোধকর। একটি পরিসংখ্যান বিশেষ উপযোগী: সুবাতাস হিসাবে স্বীকৃত হইবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার) যে সর্বাধিক সহনসীমা স্থির করিয়াছে, পৃথিবীর শতকরা ৯০ জন অধিবাসী আপন বাসভূমিতে তাহা হইতে বঞ্চিত, অর্থাৎ তাঁহারা, ওই মাপকাঠিতে বিচার করিলে, দূষণের শিকার। এমনকি বায়ুদূষণ-প্রতিরোধে অতিমাত্রায় সচেতন ও সক্রিয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতেও ৭৫ শতাংশ মানুষ ষোলো আনা সুবাতাসে বঞ্চিত! কুবাতাসের বিশ্বায়ন বলিলে মিথ্যা বলা হইবে না।
কিন্তু পূর্ণ সত্যও বলা হইবে না। সত্যের অপর অর্ধটি ইহাই যে, বায়ুদূষণের মাত্রা সর্বত্র এক নহে। ইউরোপের বাতাস যদি দুই আনা দূষিত হয়, ভারতে বা চিনে বহু স্থানেই তবে বিষের অনুপাত পনেরো আনা। বস্তুত, এই দুইটি দেশই বায়ুদূষণে ও তাহার ক্ষতির পরিমাপে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে। এবং, চিন অধুনা দূষণ প্রতিরোধে স্বভাবসিদ্ধ উদ্যমে তৎপর হইয়াছে, আর ভারত— আপন স্বভাবে সুস্থিত থাকিয়া— গজেন্দ্রগমনে পরিতৃপ্ত। কোনও কাজ হয় নাই বলিলে অন্যায় হইবে। ঘরে ঘরে রান্নার গ্যাস পৌঁছাইয়া দিবার প্রকল্প হইতে শুরু করিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার উপর নির্ভরশীলতার অনুপাত কমানো, বিভিন্ন উদ্যোগ চলিতেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাহার গতিও অধুনা কিঞ্চিৎ দ্রুততর। কিন্তু সঙ্কটের বহর যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহার তুলনায় অগ্রগতি অকিঞ্চিৎকর। বাতাসে বস্তুকণা এবং বিবিধ রাসায়নিকের আধিক্য কী ভাবে ফুসফুস মারফত শরীরের বিপুল ক্ষতি সাধন করে, বিভিন্ন মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপ বাড়ায়, মৃত্যু অবধি ডাকিয়া আনে, তাহার বহু তথ্য উপরোক্ত রিপোর্টটিতে আছে, যেমন আছে বহু রিপোর্টে। এই মর্মান্তিক সত্যও আজ আর কাহারও অজানা নহে যে, বায়ুদূষণের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুদের স্বাস্থ্য। অভাব তথ্য বা জ্ঞানের নহে, অভাব চেতনার। তাহার স্পষ্ট প্রমাণ— লোকসভা নির্বাচনের বিপুল প্রচার অভিযানে কথাসরিৎসাগর রচিত হইতেছে, চিৎকারের ঠেলায় ব্রহ্মলোক অবধি প্রকম্পিত, কিন্তু পরিবেশ দূষণের কথা কেহ শুনিবেন না, কারণ কেহ বলিবেন না। পরিবেশ, আক্ষরিক অর্থেই, অনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy