Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঘেঁটুপুজো, বাঙালির বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি

ঋতু পরিবর্তনের সময় খোস, চুলকানি-র মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই ঘেঁটু ঠাকুরের পুজোর উদ্ভব বলে মনে করা হয়। কিছু জায়গায় তাই, ঘেঁটুকে ‘চর্মরোগের দেবতা’ বলে। লিখছেন পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ঋতু পরিবর্তনের সময় খোস, চুলকানি-র মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই ঘেঁটু ঠাকুরের পুজোর উদ্ভব বলে মনে করা হয়। কিছু জায়গায় তাই, ঘেঁটুকে ‘চর্মরোগের দেবতা’ বলে।

ঘেঁটুপুজোর জন্য প্রয়োজন হয় ঘেঁটু ফুলের। ছবি: উদিত সিংহ

ঘেঁটুপুজোর জন্য প্রয়োজন হয় ঘেঁটু ফুলের। ছবি: উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, দুই ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই ঘেঁটুকে লোকসংস্কৃতি গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু ‘আর্যেতর সমাজ থেকে উদ্ভুত অপ্রধান লৌকিক দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে লোক-গবেষকরা মনে করেন, ঘেঁটুপুজোর উদ্ভবের কারণ, ঋতু পরিবর্তনের সময়কার চর্মরোগের হাত থেকে মুক্তি প্রার্থনা। সাধারণ ভাবে আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তনের সময় খোস, চুলকানি-র মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই ঘেঁটু ঠাকুরের পুজোর উদ্ভব বলে মনে করা হয়। কিছু জায়গায় তাই, ঘেঁটুকে ‘চর্মরোগের দেবতা’ বলে অভিহিত করা হয়।

ঘেঁটুর স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তেমন কোনও শাস্ত্রীয় রীতিনীতির উল্লেখ নেই। এই দেবতার পুজোর উদ্ভব ও বিকাশের কথা জানতে তাই পুজোর পাঁচালির কাহিনির উপরেই নির্ভর করতে হয়। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, ঘেঁটু হলেন এক জন অভিশপ্ত দেবতা। তিনি কোনও একটি কুকর্মের জন্য ভগবান বিষ্ণুর রোষানলে পড়েন এবং দেবলোক থেকে নির্বাসিত হয়ে পিশাচকুলে জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন এই অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর জন্য তিনি ঘোরতর বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এমনকি, বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত যাতে শুনতে না হয়, সে জন্য তিনি কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই থেকেই ঘেঁটুর অপর নাম হয় ‘ঘণ্টাকর্ণ’। তবে কী কারণে ঘেঁটু চর্মরোগের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন তা নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, সূর্যের লৌকিক সংস্করণ হলেন ঘেঁটু। সূর্যের আলোয় চর্মরোগ সারে এই বিশ্বাস থেকেই মানুষের মনে হয়েছিল সূর্যকে তুষ্ট করতে পারলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই ধারনা থেকেই ঘেঁটু পুজোর উদ্ভব ও বিকাশ।

প্রচলিত পুজো পদ্ধতি অনুসারে দেখা যায় ঘেঁটুর কোনও নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। কোথাও কোথাও একটি ভুষোকালি মাখা মাটির হাঁড়িকে ঘেঁটুর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়ে থাকে। সেই হাঁড়িকে ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে বিগ্রহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশে সাজানো হয় গোবর, কড়ি, তেল-হলুদ মাখানো কাপড়ের টুকরো, টুকরো সিঁদুর এবং অবশ্যই ভাটফুল বা ঘেঁটুফুল। মেয়েরা সামনে বসে ছড়া কেটে চাল, গুড় ইত্যাদি অর্ঘ্য হিসেবে দেবতাকে নিবেদন করে। কোথাও আবার পুরোহিত দিয়ে শাস্ত্রীয় মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেও পুজো করা হয়। সবশেষে কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা বাঁশের লাঠি দিয়ে ভুষোকালি মাখানো হাঁড়িটিকে ভেঙে দেয়। এই পুজোর সঙ্গে কতগুলি সংস্কার জড়িয়ে রয়েছে। প্রচলিত নিয়মে, যাঁরা ভুষোকালি মাখা হাঁড়িটিকে ভাঙে তাঁদের হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। হাঁড়ির ভুষো জোগাড় করে কাজলের মতো করে চোখে পরার রীতিও কোনও কোনও জায়গায় প্রচলিত রয়েছে। লোকবিশ্বাস, এতে নাকি চর্মরোগের সঙ্গে সঙ্গে চক্ষুরোগের আশঙ্কা কমে। অনেক সময় গোবর ডেলা পাকিয়ে মুখের‌ আদলে তৈরি করে ঘুঁটে দেওয়ার মতো করে রাখা হয় বাড়ির সদর দরজার পাশে। এই মুখের আদলে কড়ি আর সিঁদুর দিয়ে নাক ও চোখ তৈরি করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই মূর্তি বাড়ির দেওয়ালে রাখলে রোগের জীবাণু এবং অশুভ শক্তি গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না।

ঘেঁটুপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঘেঁটুর গানের অনুষঙ্গ। কিছুদিন আগেও বাংলার গ্রামগুলিতে সন্ধ্যা হলে ছেলেমেয়ের দলকে ‘ঘেঁটুর গান’ গেয়ে বেড়াতে দেখা যেত। পাড়াগাঁয়ে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের কাণ্ডের বাকলের স্তর বা ‘কলা বাসনা’ কেটে ডুলি তৈরি করত। সেই ডুলিগুলি ঘেঁটুফুল দিয়ে সাজিয়ে তার ভিতরে একটা প্রদীপ বসাতো। তার পরে, একটি লম্বা কাঠিতে সেই ডুলিকে ঝুলিয়ে দু’জনে তার দু’টি প্রান্ত ধরে কাঁধে করে নিয়ে যেত। এই রকম এক একটি ঘেঁটু নিয়ে কয়েক জন মিলে একটি দল তৈরি করত। ছড়া কেটে ‘ঘেঁটু যায়, ঘেঁটু যায় খোস পালায়’, বলতে বলতে তারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘোরে। উঠোনে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে বলতে থাকে, ‘‘যে দেবে মুঠো মুঠো/ তার হবে হাত ঠুঁটো/ যে দেবে কড়াই কড়াই/ তার ঘরে সোনা ছড়াই।’ এ ভাবেই চাল ও পয়সা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পরে কোনও এক দিন সকলে মিলে জমিয়ে ভোজ খাওয়ার জন্য অল্প বয়সীরা এই বিশেষ দিনে আনন্দ উন্মাদনায় মেতে ওঠে। তিন-চার দশক আগে এই ছবিটা খুবই স্পষ্ট ছিল। ছেলেমেয়েরা ছড়াগানের ঠিক অর্থ না বুঝলেও পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুর আর কথায় তাৎক্ষণিক গান বানিয়ে ফেলত। তাতে যে কখনও অর্থ বিপর্যয় হত না তেমনটা নয়। যেমন কোথাও কোথাও বলা হয়ে থাকে, ‘‘যে দেবে বাটি বাটি/ তার কাজ হবে মাটি’।

বর্ধমান ও হুগলির অনেক গ্রামে বয়স্কদেরও ঘেঁটুর দল ছিল। হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, বাঁশি সহযোগে হরিনাম সঙ্কীর্তনের মতো ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। মুখে মুখে সহজেই গান তৈরি করে ফেলতেন। সেই সব ছড়াগানের মাধ্যমে উঠে আসত সমকালীন নানা সমস্যার কথা। আবার স্থানীয় পাড়া, প্রতিবেশীদের সম্পর্কেও বিভিন্ন রসাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক প্রসঙ্গও বাদ যেত না। সব মিলিয়ে ঘেঁটুকে উপলক্ষে রীতিমতো বিনোদনের আবহ তৈরি হত গ্রামবাংলায়।

বেশ কিছু জায়গায় কলার বাসনার পরিবর্তে লাঠিতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ঘেঁটুর প্রতীক হিসেবে হ্যারিকেন, প্রদীপ, ভুষোকালি মাখা হাঁড়ি সব প্রতীকেই জড়িয়ে রয়েছে আগুনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি। অনুজ্জ্বল আগুনের এই উপস্থিতির জন্য অনেকেই ঘেঁটুকে ‘কানা ঘেঁটু’ বলে থাকেন। কালের নিয়মে ঘেঁটু সংক্রান্তি প্রতি বছরই আসে। কিন্তু ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে উদ্‌যাপনের উন্মাদনা।

প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী এবং মশাগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ritual Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE