Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Hari Vasudevan

এক অনুসন্ধিৎসু মনের সান্নিধ্য

১৯৯২-এর শীতে হরি আমাকে যে প্রকল্পে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন, সেটা শুনে নিতান্ত ক্লান্তিকর কেরানির কাজ বলে মনে হয়েছিল।

মধুমিতা মজুমদার
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২০ ০০:২৮
Share: Save:

অধ্যাপক হরি বাসুদেবনের ক্লাসে তাঁর কাছে পড়ার পাশাপাশি যদি ক্লাসের বাইরেও তাঁর বন্ধুত্বের স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য কারও হয়ে থাকে, সে বুঝবে কেমন ‘শিক্ষক’ ছিলেন তিনি। আমরা ‘হরি’ই বলতাম— ছাত্রদের মন জয় করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর মৃত্যু নিছক এক প্রিয় অধ্যাপক বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রাশিয়া-বিষয়ক চর্চার এক পণ্ডিতের প্রয়াণ নয়, একটা জগৎ শূন্য হয়ে যাওয়া। সেই জগৎটা তিনি আমাদের জন্য তৈরি করেছিলেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কথায়, ভাবনায়, প্রজ্ঞায় ভরে রাখতেন সেই জগৎটাকে।

তাই ভেবে অবাক লাগছে না যে আমদাবাদে আমার কাছে তাঁর আকস্মিক প্রয়াণসংবাদ পৌঁছনোর পর আমি কাঁদতে বসিনি, বরং পড়ার ঘরে গিয়ে রাশিয়ার ইতিহাসের উপর পুরনো নোট খুঁজে বার করে মার্জিনের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে দেখছিলাম। এগুলো সাধারণ ক্লাসনোট নয়, তাঁর সঙ্গে তিন মাসের এক দীর্ঘ কথোপকথনের পরে লেখা। ১৯৯২ সালে এমএ পাশ করার পর তিন মাসের জন্য আমি তাঁর সঙ্গে একটা ছোট গবেষণাপ্রকল্পে কাজ করি— সেই সূত্রেই এই আলোচনা। হরি কী বিশ্বাস করতেন, এই নোটগুলো স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। তাঁর কাছে পড়াশোনা ছিল— সারা জীবনের ব্যাপার, মাঝে মাঝেই নিজেকে নতুন করে গড়ে নেওয়া। ছাত্ররা সবাই যেন ‘চালু প্রকল্প’, আর তাঁর কাজ হল ইতিহাসে তথা বিশ্ব জুড়ে সাড়া ফেলা ‘বৃহৎ আলোচনা’য় শামিল হওয়ার জন্য ছাত্রদের তৈরি করে দেওয়া। কবে কখন এই আলোচনার সূচনা হবে, সেটা বড় কথা নয়— আসল কথা হল আমরা আগ্রহী হয়ে উঠে আলোচনায় যোগ দেব।

১৯৯২-এর শীতে হরি আমাকে যে প্রকল্পে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন, সেটা শুনে নিতান্ত ক্লান্তিকর কেরানির কাজ বলে মনে হয়েছিল। ১৯৮৯-এ সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরের রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে খবরের কাগজের কাটিং-এর একটা বিরাট বান্ডিল গুছিয়ে সাল-তারিখ অনুযায়ী সাজাতে হবে। তার পর প্রধান প্রধান খবরগুলোর সারসংক্ষেপ করে একটা নড়বড়ে কম্পিউটারে তুলতে হবে। হরির ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে কাজ করতে করতে প্রত্যেক দিন বিকেলে আমার যখনই মনে হত কাজটা এ বার ছেড়ে দেব— ঠিক তখনই হরি ঝড়ের মতো ঢুকে জিজ্ঞাসা করতেন, বলতে পারো, বরিস ইয়েলত্সিন এর পর কী করবে, ও কি অভ্যুত্থান সামলাতে পারবে? গোর্বাচভ কি চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে? আদর্শবাদ হিসেবে কমিউনিজ়ম কি মুছে যাবে?

এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার কাছে ছিল না, তাই হরি নিজেই যা বলার, বলতেন। এক দিন জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কোনও প্রশ্ন আছে কি না। আমি বলেছিলাম, ‘রুশচিন্তক’ (রাশিয়ানিস্ট) হওয়াটা তিনি বেছে নিলেন কেন? হরি বললেন, ১৯৭০ কি ’৮০-র দশকে রুশ ইতিহাস বা ইঙ্গ-মার্কিন গবেষকদের ভাষায় ‘সোভিয়েট স্টাডিজ়’ যে কোনও তরুণ পিএইচ ডি ছাত্রের কাছে অন্যতম সেরা পছন্দের বিষয় ছিল। নতুন, আগ্রহ-জাগানো ক্ষেত্র— শুধু অনুসন্ধানের অপেক্ষা।

১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েট আর্কাইভস-এর একাংশ খুলে দেওয়া হল। প্রকাশ্যে এল ‘সামাজিক প্রশ্ন’ বিষয়ক নথিপত্র। উঠে এলেন মার্কিন ও ব্রিটিশ গবেষকদের নতুন প্রজন্ম, যাঁরা ঠান্ডা যুদ্ধের ধ্যানধারণার বাইরে বেরিয়ে সোভিয়েট ইতিহাস চর্চা করতে চাইলেন। সোভিয়েট প্রসঙ্গে মূলধারার ইতিহাসের মধ্যেই নতুন বিতর্ক তোলার রাস্তা খুলে গেল। ঠান্ডা যুদ্ধ পর্বের অধিকাংশ ইতিহাসেই যেমন সোভিয়েট শাসনতন্ত্রকে ‘সর্বগ্রাসী ত্রাসের রাজত্ব’ বলে দেখানো হত, ‘সামাজিক ইতিহাস’, ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ ইত্যাদি প্রেক্ষিতে বিচার করে সেই পুরনো মডেল থেকে দৃষ্টি সরানোর উপায় হল। এমন সব প্রশ্ন তোলার সুযোগ এল যা আগে নিষিদ্ধ ছিল।

নতুন প্রজন্মের গবেষকরা আমেরিকা-পোষিত কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচারের বাইরে গিয়ে সোভিয়েট শাসনকে তার প্রকৃত চেহারায় বুঝতে চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রেরণা ছিল আমেরিকার বিরোধী সংস্কৃতি ও ষাটের দশকের ভিয়েতনাম-বিরোধী বিক্ষোভ। তাঁরা কমিউনিস্ট শাসনে সমাজজীবনের নানা স্তরকে দেখতে চেয়েছিলেন, বুঝতে চেয়েছিলেন বলশেভিক বিপ্লবের দীর্ঘ ইতিহাসকে। লিয়োপোল্ড হেমসন, শিলা ফিটজ়প্যাট্রিকের মতো আরও অনেকের নেতৃত্বে এই সংশোধনবাদী পণ্ডিতদের কথা হরি বলেছিলেন ইউরোপের ইতিহাস পড়ানোর সময়, কিন্তু সোভিয়েট চর্চা তথা সামগ্রিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই সংশোধনবাদের গুরুত্ব আমরা তখন বুঝতে পারিনি।

তিন মাস হরির সঙ্গে কাজ করার সময় তিনি তাঁর বৌদ্ধিক জগতে আমাকে সাদরে ডেকে নিয়েছিলেন। সংশোধনবাদী পণ্ডিতদের দুই প্রজন্ম সোভিয়েট চর্চায় যে পরস্পরবিরোধী ধারার সূচনা করেন, তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে কখনও কখনও তাঁর সমস্যার কথা, ঠান্ডা যুদ্ধ পর্বের ইতিহাসবিদদের প্রতিক্রিয়া, সোভিয়েট আর্কাইভসের সমৃদ্ধি ও জটিলতা, সামাজিক ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক তত্ত্ব নিয়ে যে সব বিতর্ক সোভিয়েট চর্চার ভোল পাল্টে দিয়েছিল, সে সবের কথা তাঁর কাছে জানতে পেরেছিলাম।

রাশিয়া হরির বিশেষ চর্চার জায়গা হলেও তিনি নিছক ‘রুশচিন্তক’ ছিলেন না। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন এক জন ইতিহাসবিদ। সাধারণ কৌতূহল দিয়েই তিনি দূর-দূরান্তের মানুষ, তাদের জগৎ, বিচিত্র প্রেক্ষিত আর বিভিন্ন গবেষণাপদ্ধতিকে অনায়াসে সংযুক্ত করতে পারতেন। আমার ধারণা, তিনি বিশ্বাস করতেন যে ছাত্রদের মধ্যে এই কৌতূহল চারিয়ে দিতে পারাটাই তাঁর আসল কাজ।

হরি বাসুদেবন এমনই শিক্ষক যে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরিচয়ের চৌত্রিশ বছরের পুরোটাই যেন মনে হয় এক দীর্ঘ কথোপকথন। তিনি না থাকলেও সেই কথোপকথন শেষ হয়ে যাবে না। আমি ‘রুশচিন্তক’ নই, সোভিয়েট চর্চার গবেষকও নই। কিন্তু হরি আমার এবং আরও অনেকের জন্য নতুন করে যে পৃথিবীর ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, তা ছাত্রছাত্রীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।

হিউম্যানিটিজ় অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, ধীরুভাই অম্বানি ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন কমিউনিকেশন টেকনলজি, গাঁধীনগর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hari Vasudevan COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE