Advertisement
E-Paper

ব্যাগ নয়, বাবা বলত থলে

সেই থলেরা এমনি সময় থাকত নানা জায়গায়। বাজারের থলে থাকত রান্নাঘরের হলুদ দেওয়ালের গায়ে লাগানো পেরেকে। মাঝে মাঝে সেই বাজারের থলের পেছনে বাসা বুনত রান্নাঘরের আরশোলা আর মাকড়সা।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৮ ০০:২১

সেই তিরাশি-চুরাশি সালে তার বাবার মাইনে একটা রুমালেই ধরে যেত। বাবার ছিল রুমাল আর অনেক ক’টা থলে। কোনও থলেতে আনত মাইনে, কোনও থলেতে আনত ঠাকুরের ফুল-মিষ্টি, কোনও থলেতে আনত কাঁচা-বাজার, কোনও থলেতে আনত মাছ-মাংস। নাইলনের নয়, সেই সব কাপড়ের থলে। বাবা তাদের ব্যাগ বলত না, থলিও বলত না বলত থলে।

সেই থলেরা এমনি সময় থাকত নানা জায়গায়। বাজারের থলে থাকত রান্নাঘরের হলুদ দেওয়ালের গায়ে লাগানো পেরেকে। মাঝে মাঝে সেই বাজারের থলের পেছনে বাসা বুনত রান্নাঘরের আরশোলা আর মাকড়সা। আরশোলা মাকড়সায় খুব ভয় পেত বলে সে রান্নাঘরের থলেতে হাত দিত না। ঠাকুরের ফুল-মিষ্টি আর মাসপয়লার মাইনে আনার থলে ছিল কুলীন। মাইনের থলে থাকত আলমারির লকারে। মাসে এক বার সে-থলে যেত ট্রেজারি অফিস। ফুল-মিষ্টি আনার থলে থাকত ঠাকুরের তাকের এক পাশে। যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা। বৃহস্পতিবার খুব সকালে লক্ষ্মীপুজো করত মা। বুধবার বিকালে বাবা সেই থলে করে নিয়ে আসত ঠাকুরের ফুল-মিষ্টি। তার ধারণা ছিল মা লক্ষ্মীপুজো করে বলেই মাসপয়লায় বাবার বেতন হয়। কোনও কোনও মাসে অবশ্য এক তারিখের বদলে তিন চার তারিখ হয়ে যেত। মাসের সেই দু-তিনটে দিন মা-বাবা বেশ চিন্তায় থাকত। সন্ধ্যাবেলায় ক্যালেন্ডারের ছবি কেটে বাঁধানো ঠাকুরকে ধূপ-বাতাসা দেওয়ার সময় সে মাকে বলতে শুনত, ‘ঠাকুর কাল যেন ওর মাইনে হয়।’ ঠাকুর কী শুনতেন কী বুঝতেন বলা মুশকিল। তবে বাবার মাইনে হত।

পুরুলিয়ার যে অফিস বাবা চালাত তাতে কাজ করত আরও তিন জন। মাইনের দিন তাদের অফিসের দায়িত্ব দিয়ে বাবা সকালবেলায় স্নান করে সাইকেল চালিয়ে রওনা দিত ট্রেজারি অফিসের দিকে। সে কোনও দিন ট্রেজারি অফিস দেখেনি। খুব দেখবার শখ ছিল তার। কলকাতা থেকে নাকি টাকা আসত পুরুলিয়ার ট্রেজারি অফিসে। সেখানে থাকে বন্দুকওয়ালা কাকুরা। তারা যে সে লোককে সেখানে ঢুকতে দেয় না। তার বাবাকে দেয়। বাবা সাইকেল বাইরে রেখে ঢুকে পড়ে ট্রেজারি অফিসের ভেতর। বাবার সঙ্গে ঢোকে বাবার মাইনে আনার থলে আর রুমাল। মাইনের টাকা বাবা দু’ভাগে রাখে। রুমালের ভেতর বাবা নিজের টাকা ক’টা বেঁধে নেয়। বাকি তিন জনের টাকা রাখে থলেতে। সেই থলে সাইকেলের সিটের সামনে বসার রডে পাক দিয়ে বাবা টুকটুক করে সাইকেল চালিয়ে দেয় অফিসের দিকে। আজ তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি। মাইনে হলে কে আর বেলা অবধি অফিসে থাকে! অন্যদের মাইনে বুঝিয়ে দিয়ে বাবা নিজেকেও ছুটি দেয়।

দুপুর বিকেল বেলা মা বাবা খাটের ওপর বসে। থলের ভেতর রুমাল। রুমালের ভেতর টাকা। কুড়ি পঞ্চাশ আর একশো টাকার নোটের কয়েকটা বান্ডিল। সেই বান্ডিল থেকে খোলা হবে টাকা, ভাগ ভাগ করে ঢুকে পড়বে এক একটা খামে। কোনও খামের ওপর লেখা মঙ্গলাদি, কোনও খামের ওপর লেখা মাসকাবারি, কোনও খামের ওপর লেখা বাজার, কোনও খামের ওপর লেখা বাড়িভাড়া, কোনও খামের ওপর লেখা রেশন। কতকগুলো খামের টাকার অঙ্ক বাঁধাধরা। কম বেশি হওয়ার জো নেই। যেমন বাড়িভাড়া, যেমন বাড়ির কাজের লোক মঙ্গলাদি। কতকগুলো খামের অঙ্ক যে মাসে যেমন সে মাসে তেমন। যেমন, বাজার। কোনও মাসে হয়তো দুটো বিয়েবাড়ি, কোনও মাসে হয়তো তার জ্বর হল। অমনি বাজারের বরাদ্দ টাকা গেল কমে।

কম পয়সায় বাজার খুবই ভাল করত তার বাবা, তবে মায়ের পছন্দ হত না। রান্নাঘরের হলদে দেয়াল থেকে থলে দুটো নিয়ে বাবা সকালবেলায় বাজার যেত। মাইনের থলে যে ভাবে আদর করে যত্নে সিটের সামনের রডে পাক দিয়ে রাখা হত সে ভাবে বাজারের থলে রাখা হত না। তারা ঝুলত সাইকেলের ডান আর বাঁ হ্যান্ডেলে। এক দিকে তরিতরকারি, এক দিকে মাছ। এক দিকে আমিষ, আর এক দিকে নিরামিষ। সে মাঝে মাঝে সাইকেলের রডে চেপে বাবার সঙ্গে বাজারে যেত। বাবা হাতে থলে ঝুলিয়ে ঢুকে পড়ত বাজারে। কোনও দিন সে বাজারে গিয়ে বাবাকে ছোটবেলায় টাকা শব্দটা উচ্চারণ করতে শোনেনি। বাবা সব সময় বলত পয়সা। পুরুলিয়ার বাজারে বেগুন, শাক নিয়ে যে ছেলেটি বসত প্রথমেই বাবা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াত। হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পাঁচ-দশ টাকা। বুড়ো আঙুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে চার আনা আট আনা। বাবা বেগুনের দিকে আঙুলটাকে বন্দুকের মতো তাক করে বলত, ‘এই তোর কানা বেগুন ক-পয়সা?’ যে মাসে বাজারের জন্য যত কম টাকা বরাদ্দ হত সে মাসে ‘কানা’ শব্দটার ওপর তত ঝোঁক পড়ত। বাবা যে বেগুনটাকে কেন কানা বলত সে কিছুতেই বুঝতে পারত না। দিব্যি মায়ের ভাষায় ঢলঢলে বেগুন। তবে সে জানত বাবার কেনা বেগুনকে মা কিছুতেই ঢলঢলে বলবে না। মা একমাত্র নিজের কেনা বেগুনকে ঢলঢলে বলে। মাঝে মাঝে তাদের পুরুলিয়ার ভাড়া-বাড়ির সামনে দিয়ে ঝুড়িমাথায় সবজিওয়ালা যেত। মা তাদের থেকে আনাজপাতি কিনত। মায়ের সঙ্গে বাবার বাজার করা নিয়ে অলিখিত একটা প্রতিযোগিতা চলত। মা মনে করত বাবার থেকে অনেক কম দামে মা তরিতরকারি কিনতে পারে। তা পারত। পারবে না কেন? বাবা তো তাও জিগ্যেস করত, ক’পয়সা দাম। মায়ের সে সব জিগ্যেস করার বালাই ছিল না। একটা কলাইয়ের থালা এনে টপাটপ ওজন না করে ঝুড়ি থেকে তরিতরকারি তুলত। তার পর সবজিওয়ালা কিছু বলার আগেই নিজেই কোনটার দাম ক’পয়সা ঠিক করে ফেলত। সবজিওয়ালাও মানবে না, মা-ও শুনবে না। শেষে মা বলতে শুরু করত, ‘ওরম কেন করছ? ক’টা তো সবজি। তুমি কত দিনের লোক। রোজ তোমার কাছ থেকে নিচ্ছি। তোমার মা-ও সবজি দিয়ে যেত।’ সবজিওয়ালা তো হাঁ। সে হয়তো সে দিনই তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রথম যাচ্ছে। তবে তার মা সবজি বেচত এটা ঠিক কথা। যা হোক কথার প্যাঁচে মা জিতে যেত। কলাইয়ের থালায় সবজি নিয়ে ঘরে চলে যেত। বাবার সাইকেলের দু’হ্যান্ডেলের থলে হেরে যেত মায়ের কলাইয়ের থালার কাছে।

তবে সে ছিল থলের দলে। মা তো আর দেখেনি, সে দেখেছে কত কায়দা করে থলের ভেতর কম পয়সায় সবজি ভরে বাবা। মায়ের মতো সবজিওয়ালার না-চেনা মাকে নিয়ে কথা বলতে পারে না বটে তবে বাবা খুব ভাল ফাউ নিতে পারে। লংকাওয়ালা কুড়ি পয়সায় যে ক’টা লংকা দিত তার থেকে আরও একটা দুটো বেশি নিত বাবা। তবু মা বলত বাবা ওজনে ঠকেছে। তবে ন’মাসে ছ’মাসে এক বার বাবার থলের সঙ্গে ভাব হয়ে যেত মায়ের।

এমনিতে রবিবারের আড়াইশো পাঁঠার মাংস বাবাই নিয়ে আসত। তবে বছরে এক দিন দু’দিন যে দিন পাঁচশো মাংস কেনা হত সে দিন থলি ঝুলিয়ে কাছে উমার দোকানে যেত মা। মা কাকিমারা কেউ মাংসের দোকানে যেত না বলে মাকে লাইন দিতেই হত না। মা পাঁচশো মাংস কিনত দু’ভাগে, আড়াইশো আড়াইশো করে। বলত একটা নিজের, আর একটা ডাক্তারকাকুর। মা নাকি ডাক্তারকাকুর বোন। পাড়ার ডাক্তারকাকু এমনিতে মাকে খুবই স্নেহ করতেন। মাকে দেখতে এলে টাকা নিতেন না। অনেক সময় ওষুধও দিয়ে দিতেন বিনা পয়সায়। তবে মা-তো ঠিক ডাক্তারকাকুর নিজের বোন নয়। আড়াইশো আড়াইশো মাংসতে মা খানিকটা করে মেটে ফাউ নিত। চর্বি নিত না। তার পর সেই দু’ভাগ মাংস বাড়িতে এসে মিশিয়ে ফেলত একটা কড়ায়।

পুজোর ছুটিতে শীত আসি-আসি দুপুরে সেই পাঁচশো মাংসের নরম লালচে-সোনালি ঝোল। আমি খেতাম, দাদা খেত, বাবা খেত। মা প্রায় নিত না। মায়ের নাকি মাংস খেতে ভাল লাগে না। আমি জানতাম মা যেমন ডাক্তারকাকুর বোন, মা যেমন সবজিওয়ালার মাকে চেনে, মা তেমনই মাংস খেতে ভালবাসে না, শুধু আলু-ঝোল খায়। বাবা মাংস খেতে ভালবাসত, আমরাও। মা আমাদের সেই সবটা মাংস দু’বেলা ভাগ করে দিয়ে দিত। শীত আসি-আসি বিকালে উঠোন থেকে মা তুলে আনত বাবার মাংস আনার থলে। সেটা তখন ধোয়ার পর শুকিয়ে গেছে। আবার তার জায়গা হত রান্নার ঘরের হলুদ দেওয়ালে। সেই থলের তলায় মাঝে মাঝে ঠাঁই নিত রান্নাঘরের পোয়াতি মাকড়সা।

Tradition Bags
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy