—ছবি পিটিআই।
সুবোধ বালকের প্রধান লক্ষণ, সে যাহা পায় তাহাই খায়। নেতাদের চক্ষে নাগরিক মাত্রই নাবালক। তাই কাঁচকলা সুলভ হইলে কাঁচকলা, আলু অধিক ফলিলে আলু খাইতে বলেন। ষাটের দশকে চালের আকাল তীব্র হইলে কাঁচকলা খাইতে বলিয়াছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন। হায়, বঙ্গে গোপালরা দুর্লভ, রাখালের সংখ্যাই অধিক। তাহারা সেই সুপরামর্শে কান না দিয়া চালের দাবিতে মিছিল করিয়াছিল। পুলিশের গুলি খাইয়াও ভাত খাইবার বায়না ছাড়ে নাই। প্রফুল্ল সেনই গদি ছাড়িয়াছিলেন। তবু কাঁচকলার কষটে দাগ ‘আরামবাগের গাঁধী’-কে ছাড়ে নাই। পাঁচ দশক পরে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলিলেন, আরও আলু খাইতে হইবে। তাঁহার অনুপ্রেরণায় বাজারের থলিতে বিপ্লব আসিবে কি? ‘মুন্ডু গেলে খাবটা কী?’ এই উদ্বেগ লইয়া বাঙালি বাঁচে। সেই জাতি শেষ শীতের বিচিত্র সব্জির আহ্বান উপেক্ষা করিয়া আহারের পাতে বারোমেসে আলুকে আরও আরও স্থান দিবে, এমন চিন্তাই বৈপ্লবিক। একেই বঙ্গে বিরিয়ানি হইতে বার্গার, সকলই আলুময়। আলুর মতো শর্করাপ্রধান খাদ্য এড়াইবার নিদান দিতেছেন চিকিৎসকেরা। তাহাতে কী? স্বাস্থ্য বড়, নাকি মা-মাটি-মানুষের স্বার্থ? রাজ্যবাসী জানে, ইতিপূর্বে এক বার বেশি করিয়া সিগারেট খাইবার প্রস্তাবও দিয়াছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সারদাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল গড়িতে তখন সিগারেটে কর বসাইয়াছিল তাঁহার সরকার।
ধরিয়া লওয়া যায়, বেশি করিয়া আলু খাইতে বলা আসলে দিদির রসিকতা। কিন্তু বাঙালি কত আলু খাইলে বাংলার চাষি বাঁচিবে? প্রশ্নটি রুচি বা সদিচ্ছার নহে, চাহিদা ও জোগানের। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দেশে চরম খাদ্যাভাব ছিল, তাই কৃষিনীতি ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির নীতি। আজ ফসল উদ্বৃত্ত, খাদ্যাভাব কমিয়াছে। চাষির সঙ্কট কিন্তু কমে নাই। অতি-ফলনের ফলে ফসলের দাম পড়িলে ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষি। এই সঙ্কটের পুনরাবৃত্তি চলিতেছে, কারণ কৃষিতে পরিবর্তন আসিলেও কৃষিনীতির পরিবর্তন নাই। ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করিতে কৃষিপণ্য বিপণনে উন্নতি চাই, কিন্তু সে কাজ উপেক্ষিত। ধান ও আলু, রাজ্যের দুইটি প্রধান ফসলই রাজ্যের চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপন্ন হয়। স্থানীয় বাজারে যথেষ্ট চাহিদা নাই, বাহিরের বাজারও মেলে নাই। সরকারের উভয়সঙ্কট। কৃষিঋণে ভর্তুকি, সুলভে সার, বীজ, জল দিয়া চাষের খরচ কমাইতেছে, আবার চাষির ক্ষতি পুরাইতে সেই ফসল কিনিতেছে। এই অপব্যয়ের নাম ‘কৃষিনীতি’।
বিশেষত আলুচাষির সঙ্কট অনেকটাই রাজ্য সরকারের সৃষ্টি। ২০১৪ সালে অন্য রাজ্যে আলু চালান বন্ধ করিয়াছিল সরকার। তাহাতে পড়শি রাজ্যগুলিতে যে বাজার হারাইল বাংলার আলু, আজও তাহা ফিরিয়া পায় নাই। তামিলনাড়ু, ওড়িশা, বিহার, অসম প্রভৃতি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের উপর আস্থা হারাইয়া নিজেরাই আলুচাষ করিতেছে। রাশিয়া প্রভৃতি ইউরোপের দেশে বাংলার আলুর রফতানিও কমিয়াছে। তাহার উপর এই বৎসর উৎপাদন আশাতীত হওয়ায় সঙ্কটও তীব্র। চাষির ক্ষোভ সামলাইতে সরকার ঘোষণা করিয়াছে, সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা ব্যয়ে দশ লক্ষ টন আলু কিনিবে। কিন্তু একশো ত্রিশ লক্ষ টন উৎপাদনের মাত্র দশ লক্ষ টন কিনিলে বাজারে আলুর দাম উঠিবে কি? সে প্রশ্নটি কেহ করে নাই। অতঃপর দশ লক্ষ টন ‘সরকারি আলু’ সংরক্ষণ করিতেও বাড়তি খরচ হইবে। বাজারে আলুর দাম না বাড়িলে তাহা লোকসানে বিক্রয় করিতে হইবে, অথবা ফেলিয়া দিতে হইবে। অপচয় ঠেকাইতে আরও অপচয়, এই ভ্রান্ত নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। আলু তথা যে কোনও ফসলের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, রফতানিতে উদ্যোগী হউক সরকার। নাগরিক বেশি আলু খাইলে শেষে ইনসুলিনে অধিক ভর্তুকি দিতে হইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy