Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Amphan

আত্মশক্তির সাধনা

সংগঠনের উদ্যোগীরা কাজ শুরু করিয়াছিলেন প্রধানত ত্রাণ সরবরাহের লক্ষ্যে। কিন্তু অচিরেই কেবলমাত্র ত্রাণের আয়োজনে সীমিত না থাকিয়া তাঁহাদের অনেকের হাতেই তুলিয়া দেওয়া হয় অর্থ উপার্জনের উপযোগী ছোটখাটো পুঁজি। এই ভাবেই ত্রাণ হইতে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথে অগ্রগতি।

ঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড ঘর বাড়ি। ফাইল চিত্র।

ঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড ঘর বাড়ি। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২০ ০১:৪৩
Share: Save:

অতিমারির বিপদের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ প্রান্তে ঘণ্টায় প্রায় একশো মাইল বেগে আছড়াইয়া পড়িয়াছিল আমপান। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় অনিবার্য ভাবে সুন্দরবনের অধিবাসীদের মনে করাইয়া দিয়াছিল প্রায় এক যুগ পূর্বের আয়লার স্মৃতি। ২০০৯ সালের সেই বিপর্যয়ে বহু মানুষের আক্ষরিক অর্থে সর্বনাশ ঘটে, আরও অগণন পরিবার তাহার ক্ষয়ক্ষতি আজও সম্পূর্ণ সামলাইয়া উঠিতে পারে নাই, অনেকে হয়তো পারিবেও না কোনও দিন। দরিদ্র, নিঃস্ব, অসহায় নাগরিকের জীবনে বিপর্যয় একটি সাময়িক ঘটনা নহে, তাহার আঘাত দীর্ঘস্থায়ী, প্রায়শ চিরস্থায়ী। আমপানের অভিঘাত সামালাইয়া উঠিবার কাজটি আরও অনেক বেশি কঠিন করিয়া দিয়াছে কোভিড-এর সংক্রমণ এবং তাহার প্রকোপে বিপন্ন অর্থনীতি। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অনগ্রসর অঞ্চলে বিপদের মাত্রা স্বভাবতই অপরিসীম, সেখানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অধিবাসীর দুর্দশার ইতিবৃত্ত রচিত হইয়া চলিয়াছে। কিন্তু সেখানে কাহিনির শেষ নহে। এই ঘোর বিপদের মধ্যে দাঁড়াইয়াই অন্য ধরনের কাহিনিও নির্মাণ করিতেছেন কিছু মানুষ, দুঃসময়ের গ্রাস হইতে অগ্রগতির রসদ সংগ্রহ করিতেছে তাঁহাদের সদিচ্ছা ও উদ্যম। যেমন, একটি অসরকারি সংগঠনের পরিচালনায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার আটটি ব্লকে কাজ করিতেছে স্থানীয় মহিলাদের বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠী। বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, এমন নানা উদ্যোগ চলিতেছে রাজ্য জুড়িয়াই, এই সংগঠনটি তাহার একটি দৃষ্টান্ত। তাহাদের সহিত যুক্ত গ্রামবাসিনীদের মোট সংখ্যা এখন প্রায় কুড়ি হাজার। অতিমারির আগে সংখ্যাটি পাঁচ হাজারের কাছাকাছি ছিল, অর্থাৎ বিপদের দিনে স্বনির্ভরতার সন্ধান বাড়িয়াছে তিনগুণ। দৃষ্টান্তটি স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্ব কেবল সংখ্যায় নহে, কাজের পরিধি এবং চরিত্রেও। সংগঠনের উদ্যোগীরা কাজ শুরু করিয়াছিলেন প্রধানত ত্রাণ সরবরাহের লক্ষ্যে। কিন্তু অচিরেই কেবলমাত্র ত্রাণের আয়োজনে সীমিত না থাকিয়া তাঁহাদের অনেকের হাতেই তুলিয়া দেওয়া হয় অর্থ উপার্জনের উপযোগী ছোটখাটো পুঁজি। এই ভাবেই ত্রাণ হইতে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথে অগ্রগতি। আপাতদৃষ্টিতে ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু এক হাজার মাইলের অভিযাত্রাও তো প্রথম পদক্ষেপেই শুরু হয়। স্বনির্ভরতার অন্য মাত্রাও আছে। এনজিও-র পরিচালনায় প্রকল্পের কাজ শুরু হইবার পরে অনেক এলাকাতেই স্থানীয় মহিলারা বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, অর্থাৎ আর্থিক স্বনির্ভরতার সহিত তাল মিলাইয়া পরিচালনাতেও স্বনির্ভরতা বাড়ে। তাহার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পরিচালনার গুণমানেও উন্নতি হয়, বাস্তব প্রয়োজনের সহিত ত্রাণ এবং প্রকল্পের পরিকল্পনাও তুলনায় সুসমঞ্জস হয়। এহ বাহ্য। তৃতীয় একটি স্তরে সুফল পাওয়া যায়, যাহার গুরুত্ব বাস্তবিকই অ-তুলনীয়। সুন্দরবনের ওই অঞ্চলগুলি হইতে নারী পাচারের সমস্যা বিশেষ ভাবে প্রবল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে, মানুষের দুর্গতি বাড়িবার ফলে, সমস্যা বাড়িয়া যায়। আয়লার পরে তাহার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। সেই অভিজ্ঞতা হইতে অধিবাসীরা শিক্ষা লইয়াছিলেন। এই বারের বিপর্যয়ের পরে, অতিমারির বিপদ সামলাইয়াও, তাঁহারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের নূতন সামর্থ্যকে কাজে লাগাইয়া পাচারকারীদের গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ ও সক্রিয় নজরদারি চালান এবং বিপদের আভাস দেখিলেই তাহা নিবারণে তৎপর হন। এই উদ্যোগে সামাজিক সক্ষমতার যে সংসাধন রহিয়াছে, তাহার মূল্য প্রভূত।

অতিমাত্রায় উচ্ছ্বসিত হইবার কারণ নাই। কিন্তু এই কাহিনি নিঃসন্দেহে একটি সত্য জানাইয়া দেয়: স্থানীয় স্তরে সমাজ এবং অর্থনীতির নিজস্ব শক্তিকে ব্যবহার করিতে পারিলে অনেক আপাত-দুস্তর সমস্যার মোকাবিলার পথ মিলিতে পারে। এক শতাব্দী পূর্বে রবীন্দ্রনাথ পল্লিবাংলার বাস্তব অভিজ্ঞতা বিচার করিয়া স্বনির্ভর উন্নয়নের জন্য আত্মশক্তি জাগ্রত করিবার যে পথের সন্ধান দিয়াছিলেন, এই সময়ের অভিজ্ঞতা নানা ভাবে তাহার মূল্য নূতন করিয়া বুঝাইয়া দিতেছে। আত্মশক্তি জাগরণের অর্থ এমন নহে যে— দরিদ্র মানুষকে আপন সমস্যা আপনি সমাধান করিবার দায়িত্ব ছাড়িয়া দিয়া অবশিষ্ট সমাজ হাত গুটাইয়া লইবে। বাহিরের সহযোগিতা কেবল সহায়ক নহে, অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্র তথা সরকারের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোগ এবং উদ্যোগীর মধ্যে যথার্থ সমন্বয়ই এই সঙ্কট মোকাবিলার উপায়। সুন্দরবনের ইতিবৃত্ত তাহার একটি দৃষ্টান্ত।

যৎকিঞ্চিৎ

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে এ বার ‘মিথ্যার দেওয়াল’। যাত্রাপালা নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যের ফিরিস্তি, একশো ফুট লম্বা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি আজ পর্যন্ত যত মিথ্যা কথা বলেছেন, সব খোদাই করে রাখা হল এই দেওয়ালে। বিষয় অনুযায়ী আলাদা আলাদা রঙে, দূর থেকে দেখে মনে হবে চিত্রবিচিত্র এক আর্ট ইনস্টলেশন। গণতন্ত্রে দেওয়াল তোলা বড় কাজের কথা নয়, কিন্তু এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দেওয়াল কি গণতন্ত্রেরই পদচিহ্ন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE