ফোর্ট কোচির জুস টাউন ‘গডস ওন কানট্রি’ লেখা গাড়ি আর ছোট বাসে ভর্তি। তার মধ্যে থেকে বেরোচ্ছেন দলে দলে বিদেশি টুরিস্ট। পুরনো বাড়ির অপরূপ সব জানালা-দরজা দেখতে দেখতে টিকেএম ওয়্যার হাউসে পৌঁছে গেলাম। দুটো মুখোমুখি গুদাম ঘর, সেখানে এখন নেমে এসেছে কাশ্মীর। শহর-জোড়া শিল্প প্রদর্শনী, ‘কোচি মুজরিশ বিয়েনালে ২০১৮’-র অংশ, শ্রীনগর বিয়েনালে।
ঘরে ঢুকেই চোখ আটকে গেল ত্রিশ ফুটের দেওয়াল-জোড়া ক্যানভাসে। সাদা কাগজে কালো রঙে আঁকা। শুকিয়ে-যাওয়া গাছের শাখাপ্রশাখা, তাতে আটকে আছে মানুষের দেহের হাড়-শিরদাঁড়া, পাঁজর, হাত। তার ঠিক উপরে বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের পোর্ট্রেট। কারও স্বামী, কারও বাবা, সন্তান, প্রেমিক, বন্ধু হারিয়ে গিয়েছে। আঠারো-কুড়ি বছর ধরে এঁরা বুক বেঁধে বসে আছেন। কেউ ঘরের ভিতরে প্রিয়জনের ছবি আগলে বসে, কেউ দেওয়ালে টাঙানো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলছেন, কেউ চাষজমিতে শস্যের দিকে তাকিয়ে, কেউ কবরস্থানে, কেউ নামাজ পড়ছেন, কেউ ভগ্নস্তূপে বসে। এক বৃদ্ধার মুখ আর একটি ক্যালেন্ডার ধরা পড়েছে এক ফ্রেমে।। শিল্পী শওকত নন্দ কাশ্মীরের এই মহিলাদের অনেককেই ছোটবেলা থেকে চেনেন। হাজার হাজার কাশ্মীরি ‘গায়েব’ হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সামান্য কয়েক জনের পরিবারের অভ্যন্তরের ছবি দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী।
এমন অনেক জীবন কাশ্মীর উপত্যকায় লীন হয়ে আছে, এই ভাবনা থেকে মাউমুন আহমেদ তৈরি করেছেন ত্রিশ ফুটের ক্যানভাস। কাশ্মীরে বহু দশক-পেরোনো দ্বন্দ্বের মধ্যে দেখছেন প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থান। শীতের কাশ্মীর উপত্যকায় অসংখ্য নামহীন মৃতদেহের কবর। তাঁরা ওই তৃণভূমি ও পাহাড়ে দেহ হয়ে মিশে গিয়েছেন। প্রকৃতি তাঁদের স্মৃতি বহন করেছে, তাঁদের পরিবার ও গোষ্ঠীকেও।
শিল্পী সৈয়দ মুজতবা রিজ়ভি হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে নিজেকেও জুড়েছেন। ওই হারানো লোকেরা কেউ বন্ধু, আত্মীয়, কেউ বা অজ্ঞাতপরিচয় লোক। তাঁদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবির মন্তাজ করে রিজ়ভি সবাইকে জিজ্ঞাসা করেন, কে নেই এই ছবিতে? রিজ়ভি নেই, না কি অন্যরা নেই? না কি অন্যরাই আছে? শ্রীনগরের প্রতাপ পার্কে প্রতি মাসের প্রথম সোমবার হারিয়ে-যাওয়া মানুষদের স্বজনেরা ছবি হাতে নিয়ে প্রতিবাদ দেখান। হাতে ধরে-থাকা সেই সব ছবি আর চলমান সময়, শিল্পী রিজ়ভির ভাবনায় মিলেমিশে ছবির সিরিজ় তৈরি করেছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই শ্রীনগর বিয়েনালে প্রদর্শনীতে দশ মিনিটের একটা ‘ভিডিয়ো লুপ’ চলছে। আজানের শব্দ আর এক আশি বছরের কবর খননকারী বা ‘গ্রেভ ডিগার’-এর স্মৃতিচারণ। বেওয়ারিশ লাশ কবর দেন তিনি, আবার নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে একাধিক বার কবর খুঁড়ে মৃতদেহ দেখান। বৃদ্ধ একটা গান গেয়ে বলছেন, শহিদের স্মৃতি জ্বলন্ত আগুনের মতো। কাঁদছেন আর বলছেন, ‘‘কোনও শহিদের মৃতদেহে আমি কখনও পচা গন্ধ পাইনি।’’
এক দিকে তৈরি করা হয়েছে সুফি ঘরানার কাশ্মীরি কাঠের কাজের ঘর। যার ভিতরে লাল মাটি, আর তার ওপরে রাখা ছোট ছোট আধ খোলা কফিন। মনে হবে শিশুর কফিন। সেগুলোর ভিতরে মেরুদণ্ড, খুলি, জানুর লম্বা হাড়। পুরো শরীরের খাঁচা নয়, এক একটা অংশের হাড় এক একটা কফিনে। শিল্পী হিনা আরিফের কাজ। কাশ্মীরি পেপার ম্যাশ, যা টুরিস্টদের কাছে এত জনপ্রিয়, তা দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন রং-বেরঙের কফিন। শিল্পকর্মে সৌন্দর্যের প্রত্যাশা চুরমার হয়ে যায়, বাস্তব আর তার প্রতিরোধের এই প্রতিকৃতি বুকের মধ্যে চাপ তৈরি করে। সেই দিনই সকালে খবরে দেখেছি, দেশময় যুদ্ধের প্ররোচনা।
কেরলের এর্নাকুলম ও ফোর্ট কোচি শহরে এই শিল্প প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ১২ ডিসেম্বর ২০১৮। চলবে ২৯ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত। সঙ্গে আলোচনা, সিনেমা প্রদর্শনী, পারফর্ম্যান্স। শহর জুড়ে কত বড় বড় প্রদর্শনীর জায়গা। যেমন আসপিন ওয়ালে খুব বড় একটা কম্পাউন্ড, যেখানে গুদাম, বাংলো, ল্যাবরেটরি, দোকান, হ্যাঙ্গার, খোলা কম্পাউন্ড আর একটা দোতলা বাড়ির কিছু অংশে প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে। এখানে এলে বোঝা যায়, ফাইন আর্ট বা কারুশিল্পের ধারণায় শিল্প আটকে থাকতে পারে না। শিল্প জীবনসংগ্রাম, জীবনসঙ্কটকে প্রকাশ করে। শিল্প বা আর্ট দেখার নয়, বাঁচার জিনিস।
ছত্রিশটি দেশের শিল্পীদের কাজ আছে এ বার। কলকাতার শিল্পীও আছেন। সবুজ-হলুদ অটোর বিভিন্ন ফ্রেমিং। চালকের সিটে বসলে দেখা যায় যেমন চলমান রাস্তা, তাই দেখবেন দর্শক। সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারির কাজে কখনও অটোর আয়নায় দেখা রাতের কলকাতার আলো-ছায়া, কখনও বিলবোর্ড। শিল্পী বাপি দাস অটোচালক। সূক্ষ্ম তাঁর পর্যবেক্ষণ।
শিল্পীর ভাষা কেবল কি রং-তুলি, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, ইনস্টলেশন আর্ট? কাশ্মীরের শিল্প প্রদর্শনীতে ঢুকতে গিয়ে বডি সার্চের মুখে পড়তে হচ্ছে দর্শকদের। দুই কাশ্মীরি, এক পুরুষ আর এক মহিলা, ‘মেনল্যান্ড’-এর মানুষদের তল্লাশি করে চলেছেন। তল্লাশি কাশ্মীরিদের জীবনের অংশ। শিশুও ইস্কুলের পথে তল্লাশির মুখোমুখি হতে হতে বড় হয়। কোচিতে দর্শকরা বিরক্ত, অনেকে আপত্তি করছেন, কেউ কেউ তর্ক শুরু করে দিচ্ছেন। তবু শ্রীনগর বিয়েনালের ঘরে ঢোকার মুখে বারো ঘণ্টা নীরবে তল্লাশি চালিয়ে গেলেন দুই শিল্পী, সাকিব ভাট আর হিনা আরিফ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy