Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
এ কেমন দেশ, যেখানে বিরুদ্ধ স্বর মানেই দেশদ্রোহী?

রাষ্ট্রের ভাষ্য না শুনলেই

আসলে, দেশ জুড়েই বিরুদ্ধ স্বরকে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে। যাঁরা বহু বছর ধরে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছেন, তাঁদের মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে। দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহিতার মামলা। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা নির্দোষ।

প্রতিবাদ: নাগপুরে আইনজীবীদের মিছিল, ভিমা কোরেগাঁও কাণ্ডে ধৃত আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং-এর সমর্থনে। পিটিআই

প্রতিবাদ: নাগপুরে আইনজীবীদের মিছিল, ভিমা কোরেগাঁও কাণ্ডে ধৃত আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং-এর সমর্থনে। পিটিআই

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ০০:০৬
Share: Save:

দেশে রাজকন্যের সংখ্যা কম পড়তে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীর জোগান অফুরন্ত! তবে সে কথায় আসার আগে একটু ইতিহাস দেখে নেওয়া দরকার। দু’শো বছর আগে পুণের কাছে ভিমা কোরেগাঁওয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জেরে এই ২০১৮ সালে পাঁচ জন সমাজকর্মীকে জেলে যেতে হবে, ইতিহাস কি তা ভেবেছিল? এ কথাও ভাবেনি যে, দু’শো বছর পরে দলিত উত্থানের এক রক্তক্ষয়ী ও কঠিন অধ্যায় রচনা করতে হবে তাকে। তবে, বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চিরকালীন রাষ্ট্রীয় পন্থার সাক্ষী থাকতে হয়েছে ইতিহাসকে, বার বার।

১৮১৮-র ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে ভিমা কোরেগাঁও এলাকায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে মরাঠা সেনা। মরাঠা সাম্রাজ্যের তৎকালীন অধিপতি ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও। ব্রিটিশদের কাছে পর্যুদস্ত হয় মরাঠিরা। কিন্তু ঘটনা হল, ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে পেশোয়ার বাহিনীকে পরাস্ত করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন প্রধানত মহার দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা সে দিন এই যুদ্ধকে ব্রিটিশ ও মরাঠাদের যুদ্ধ হিসেবে দেখেননি। দেখেছিলেন উচ্চবর্ণের মরাঠিদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের দলিতদের যুদ্ধ হিসেবে।

ভিমা কোরেগাঁওকে আরও বিখ্যাত করে দেন বি আর অম্বেডকর। ১৯২৭-এর ১ জানুয়ারি সেখানে তাঁর সফরের পর থেকে প্রতি বছর দলিতরা ওই দিনে যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে সেখানে ভিড় করেন। এ বছরের পয়লা জানুয়ারি ওই যুদ্ধের দ্বিশতবার্ষিকী হিসেবে সেখানে বড় আকারের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু কট্টরবাদী মরাঠি সংগঠনগুলি তীব্র ভাবে এই আয়োজনের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তার জেরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে ওঠে মহারাষ্ট্রের বিরাট এলাকা। মৃত্যু হয় এক দলিত যুবকের।

তার পাঁচ মাস পরে, গত ৬ জুন নাগপুর, মুম্বই ও দিল্লি পুলিশ যৌথ অভিযানে ‘অারবান মাওয়িস্ট’ হিসেবে গ্রেফতার করল এমন পাঁচ ব্যক্তিকে, প্রকাশ্যে ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন চালানোর জন্য যাঁরা অত্যন্ত পরিচিত মুখ এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন। মুম্বই থেকে গ্রেফতার হলেন সুধীর ধাওয়ালে, দিল্লি থেকে রোনা উইলসন, নাগপুর থেকে ধরা হল আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, অধ্যাপক সোমা সেন এবং আদিবাসী অধিকার রক্ষা নিয়ে আন্দোলনকারী মহেশ রাউতকে।

তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? এই পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর থেকে নানা সময়ে পুলিশ নানা ভাষ্য দিয়েছে। পুলিশ দাবি করে, এই পাঁচ জন ভিমা কোরেগাঁওয়ে গন্ডগোলের মূলে, তার পরে জানায়, ধৃতেরা মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত এবং সব শেষে অভিযোগ আনে, রাজীব গাঁধীর মতোই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিলেন এঁরা। প্রাথমিক যে এফআইআর করা হয়েছিল, পরে তাতে ধৃতদের নাম ঢুকিয়ে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারা প্রয়োগ করা হয়।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, অভিযুক্তেরা মানবাধিকার, নারীর অধিকার রক্ষা, পরিবেশ এবং দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে সোমা সেনের কথাই ধরা যাক। সোমা নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান। ৩১ জুলাই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা। কলেজ জীবন থেকেই তিনি নারীর অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল। এ ধরনের নানা আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য নাগপুরে সোমা পরিচিত নাম।

দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা সুধীর ধাওয়ালে মহারাষ্ট্রে মানবাধিকার আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। মহারাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র ঘটনার তথ্যানুসন্ধানী দলে তিনি থাকেন। ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার পরে তিনি ‘বিদ্রোহী’ বলে একটি সাময়িক পত্রিকা বার করেন। পত্রিকাটি মাসে দু’বার প্রকাশিত হয়। তাতে নানা সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় ও জনআন্দোলনের কথা তুলে ধরা হয়। ২০১১ সালেও এক বার মাওবাদী সন্দেহে সুধীরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলি‌শ যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যদিও তিনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ হতে হতে প্রায় সাড়ে তিন বছর কেটে যায়। তাঁকে গোন্ডিয়া জেলে বন্দি থাকতে হয়।

আর এক ধৃত রোনা উইলসন আদতে কেরলের কোলাম জেলার লোক। পরে দিল্লির জেএনইউ-তে পড়ার সময় থেকেই নানা সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন রোনা। দেশের নানা প্রান্তের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ‘কমিটি ফর রিলিজ় অব পলিটিক্যাল প্রিজ়নার্স’ (সিআরপিপি) গঠন করেন সংসদভবন আক্রমণে অভিযুক্ত এস এ আর গিলানি। রোনা উইলসন এই কমিটির সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে যুক্ত। কিছু দিন আগেই তিনি ব্রিটেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণাপত্রের প্রস্তাবনা পাঠান। তাঁর ইচ্ছে ছিল, গবেষণার কাজ শেষ করার।

সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের খ্যাতি শুধু সামাজিক আন্দোলনকারী হিসেবেই নয়, তিনি দলিত ও আদিবাসীদের হয়ে আইনি লড়াই চালান। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্যও আইনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সুরেন্দ্র। এই সব মামলা তিনি লড়েন বিনা পারিশ্রমিকে। ইউএপিএ-র মতো বিভিন্ন কালা আইনের বিশেষজ্ঞ নাগপুরের এই মানবাধিকার কর্মী। গ্রেফতার হওয়ার আগেও সুরেন্দ্র আইনি লড়াই লড়ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এন সাইবাবার জন্য। মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। হুইলচেয়ারেই ঘোরাফেরা করতে হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী এই অধ্যাপককে।

পঞ্চম ধৃত, মহেশ রাউত, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এলাকার যুবক। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ (টিআইএসএস) পড়াশোনা করেছেন তিনি। প্রাইম মিনিস্টার রুরাল ডেভেলপমেন্ট (পিএমআরডি)-এর ফেলোশিপও পেয়েছেন। গঢ়চিরৌলির আদিবাসী অঞ্চলে প্রচুর সামাজিক কাজকর্ম আছে তাঁর। ‘বিস্থাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন’ নামে সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়কও তিনি। পশ্চাৎপদ জনজাতি ও আদিবাসীদের সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের বিরোধ সর্বজনবিদিত। তাঁর নামে একাধিক মামলাও ঝুলছে। তাঁর মুক্তির দাবিতে টিআইএসএস-এর কর্মী, ছাত্র ও প্রাক্তন ছাত্র মিলিয়ে ২১৮ জন স্বাক্ষর করে একটি বিবৃতি জারি করেছেন। তাতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

দলিত, আদিবাসী ও পশ্চাৎপদ মানুষদের জন্য দীর্ঘ কাল আন্দোলন করে আসছেন যাঁরা, ভূমিপুত্রদের প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চান যাঁরা, আদিবাসী ও জনজাতিদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে চান যে মানুষগুলো, তাঁদের বিরুদ্ধে কর্পোরেট লবি এবং রাষ্ট্রশক্তির রোষের ধারাবাহিকতা চিরকালীন। প্রতিবাদীদের মাওবাদী তকমা দিয়ে ধরা হচ্ছে, অথচ, এফআইআর-এ নাম থাকা সত্ত্বেও ভিমা কোরেগাঁওয়ে প্রকৃত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে বার বার। এ নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন হলেও তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি প্রশাসন।

আসলে, দেশ জুড়েই বিরুদ্ধ স্বরকে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে। যাঁরা বহু বছর ধরে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছেন, তাঁদের মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে। দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহিতার মামলা। প্রয়োগ করা হচ্ছে ইউএপিএ-র মতো ভয়ঙ্কর আইন, যাতে অন্তত ছ’মাস অভিযুক্তদের জেলে রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা নির্দোষ। আলাদা আদালতে, কার্যত সমান্তরাল বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাঁদের। এ ভাবেই ধরা হয়েছিল ছত্তীসগঢ়ের মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেনকে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তিনি এখন জামিনে মুক্ত আছেন।

এ এমন এক সময়, এমন এক আবহ, যেখানে যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা-বিবেকের ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। এই আবহে রাষ্ট্রশক্তিকে বোঝানো দুষ্কর যে, যে সামাজিক বিষয় জনমানসকে ভাবায়, উত্ত্যক্ত করে, জনমত তৈরি করে, উত্তেজিত করে, সেখানে নানা রকম ভাষ্য ও মতবাদ আসবেই। সেখানে শুধু সরকারি ভাষ্য থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের ভাষ্য মাথা নত করে না শুনলে যেখানে দেশদ্রোহীর তকমা পেতে হয়, সেখানে গণতন্ত্রের ভাঁওতা দেওয়া কেন?

ইন্দিরা গাঁধী ঘোষণা করে ’৭৫-এর জুনে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। বর্তমানের সঙ্গে ৪৩ বছর আগের তফাত একটাই।

এখন সেটা অঘোষিত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE