কলকাতার ঘটনা। ২০০৭-এর ২৯ ডিসেম্বর দুপুর। ভবানী ভবনের চার তলায় সিআইডি-র সদর দফতরে স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ-এর ঘরের মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে এক যুবককে। নীল জিন্স, ময়লা সাদা টি শার্ট। হাত দুটো হাতকড়া-বন্দি, পিছমোড়া। চেহারা ভাল, তবে চোখেমুখে বিহ্বলতার ছাপ। এক সিনিয়র ইনস্পেক্টর বললেন, ‘কী বুঝলে! খুব বড় মাপের সন্ত্রাসবাদী। পাকিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা। মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে যায় আর বিস্ফোরক নিয়ে আসে। এমন এক জন কলকাতায় বাসা বেঁধে ছিল, আমরা জানতামই না!’
আরও পড়ুন: বিশ্বাস করেই ঠকলেন মা
গোয়েন্দারা বলেছিলেন, আফতাব আলম আনসারি নামে কাশীপুর রোডের বস্তির বাসিন্দা ওই যুবক জঙ্গি সংগঠন হুজি-র চাঁই। সে বছর লখনউ, বারাণসী ও ফৈজাবাদ আদালত চত্বরে বিস্ফোরণ ঘটাতে কলকাতার আফতাবই নাকি ট্রেনে করে আরডিএক্স উত্তরপ্রদেশে পৌঁছে দিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আফতাবকে সে রাজ্যে নিয়ে যায়। আর বাংলা জুড়ে শুরু হয় হইচই। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিজি আনন্দবাজারকে টেলিফোনে বলেন, ‘কলকাতায় ধরা পড়া যুবক ভয়ঙ্কর এক জঙ্গি। তার বিরুদ্ধে আমরা প্রশ্নাতীত প্রমাণ পেয়েছি।’ এই সব ‘প্রমাণ’-এর বাইরে পেট থেকে কথা বার করতে আফতাবের জোড়া করে বাঁধা দু’পায়ের তলায় দেদার ডান্ডা মারা হয়েছিল। আফতাব বলার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি আদৌ জঙ্গি নন, সিইএসসি-র ছাপোষা এক কর্মী। পুলিশের হুঙ্কারে ও মারের আওয়াজে তাঁর আর্তনাদ ও কান্না চাপা পড়ে যায়।
তবে এক মাস কাটার আগেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বুঝতে পারে, মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে। আফতাব সত্যিই জঙ্গি নন। আসলে যাদের খোঁজা হচ্ছিল, সেই দু’জনের সঙ্গে আফতাবের জামাইবাবু ট্রেনের একই কামরায় যাচ্ছিলেন। তাদের এক জনের মোবাইল থেকে উনি ফোন করেন আফতাবকে। অন্যের ফোনে টাকা উঠবে ভেবে আফতাব দু’-এক কথার পরেই লাইন কেটে দিয়ে কাশীপুরের একটি পিসিও থেকে ওই মোবাইলে ফোন করেন। যত বিপত্তি এখান থেকেই।
ভাল ভাবে যাচাই না করেই এক জন নিরপরাধকে এত মারধর করা হল? সিআইডি-র এক ডিআইজি-র হেলদোলহীন জবাব ছিল, ‘ভুল হতেই পারে। শুধরে যে নেওয়া হয়েছে, সেটাই তো ভাল।’ যেন শুধরে নিলেই কুড়ি দিন ধরে গোটা পরিবারের বদনাম, নিরীহ যুবকের মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা, অপমান, সব মাফ! কাশীপুর রোডের বস্তির এক চিলতে ঘরে আফতাবের মা এই সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘তোমরাই আমার ছেলেকে, আমাদের পরিবারকে কলঙ্কিত করেছ।
এ বার তোমাদেরই কলঙ্ক মুছতে হবে।’
সমস্যা হল, আমাদের সেই পুলিশের মুখেই ঝাল খেতে হয়। তা ছাড়া, যে খবরে যত মুচমুচে ‘গল্প’ থাকে, তার দর তত বেশি। সেগুলোর জন্য ‘অফিশিয়াল ব্রিফিং’ বা অফিসারদের একাংশের ‘আনঅফিশিয়াল গল্পগাছা’-র বাইরে সাংবাদিকের নিজের তদন্ত করার সুযোগ ও সময় কতটুকু? জঙ্গির খবর পুলিশ ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘খাওয়াচ্ছে’ না অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভুল করছে, তা যত ক্ষণ না যাচাই করতে পারছি, তত ক্ষণ খবর ফাইল করব না— এই অবস্থান সাংবাদিকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব? উপরওয়ালার ভর্ৎসনা পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, অন্য চ্যানেল বা কাগজ বড় করে ছাপলে বা দেখালেই তো আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয়, ইস, এ সব গল্প তো আমার কাছেও ছিল, পেয়েও ছেড়ে দিলাম!
আফতাবের মা’র সামনে মাথা নিচু হলেও তাই কিছু করার থাকে না। অপ্রতিভ অবস্থা কাটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় মুখরোচক স্টোরির সন্ধানে।