কাঠুয়া ধর্ষণ সংঘটিত হয়ে পেরিয়ে গেছে তিন মাসেরও বেশি। আর আমরা জেনে শিউরে উঠেছি তা-ও প্রায় এক পক্ষকালের মুখোমুখি। অনেক প্রতিবাদ, অনেক মোমবাতি, অনেক হ্যাশট্যাগ-এর পক্ষকাল। ঘুম কেড়ে নেওয়া অসংখ্য তথ্য ও খুঁটিনাটি জানার পক্ষকাল।
এই পুরো সময়টায় একটাই প্রশ্ন আমার মতো আরও অসংখ্য মায়ের মনে হয়তো এসেছে, যাদের কন্যাসন্তান আছে। যদি আসিফা আমার মেয়ে হত? বাড়ি থেকে বাইরে পা দিত, ফিরত না এবং তার থেঁতলানো মুখের শরীরটা পেতাম মেয়ের পরিবর্তে?
আসিফা কি আমাদের কারও মেয়ে হতে পারত? যা যা তার সঙ্গে ঘটেছে, তা হতে পারত আমাদের মেয়ের সঙ্গে? আমরা জানি, এর উত্তর হ্যাঁ। আমরা হয়তো কাশ্মীরবাসী পশুপ্রতিপালনকারী যাযাবর শ্রেণির অংশ না হয়ে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, হয়তো আমাদের আসিফাকে ঘোড়া চড়াতে একা একা জঙ্গলে যেতে হত না। পার্থক্য এই একটাই। পরিণাম সবার ক্ষেত্রে একই রকম, বীভৎসতার রকমফের।
ক্রাই (চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ) সংস্থার পরিসংখ্যানও একই কথা বলে। প্রতি পনেরো মিনিটে একটি শিশু নির্যাতিত হচ্ছে, সেই শিশু যার মধ্যে আপনার মেয়ে বা ছেলেও থাকতে পারে। যে মেয়েটিকে তার বাবা নিজের বন্ধুদের হাতে তুলে দেয়, তার পর নিজেও নির্যাতনে অংশ নেয়, তার ঘটনার কথা বলব? না কি চোদ্দো বছরের যে কিশোরীকে রাস্তার ধারে কয়েকটি যুবক কয়েক ঘণ্টা ধরে ধর্ষণ করে, সেই ঘটনার কথা? ভারতে অর্ধেকের বেশি নাবালিকা যৌন নির্যাতনের শিকার। সুরাতের মেয়েটির কথা আমাদের সবার জানা বা ইন্দৌরের ঘটনা, যেখানে আট মাসের শিশু (মেয়ে তো বটে) ধর্ষিত হয়।
সব তথ্য জানার পরও, কিছু সীমিতসংখ্যক দুঃস্বপ্ন দেখার পরও আমরা চিন্তিত হই, হয়তো আলোড়িতও হই, কিন্তু আতঙ্কিত হই না। যে ভাবে স্কুল ক্যাম্পাসে শিশু নির্যাতনের ঘটনার সামান্য উল্লেখে আমাদের আপাত নিশ্চিন্তি টলে যায়, কাশ্মীরের কাঠুয়াকাণ্ডে ততটা টলে কি? কারণ আমরা জানি, অন্তরের অন্তঃস্থলে জানি, আসিফা আমাদের মেয়ে হতে পারত না। নির্ভয়া আমাদের মেয়ে হতে পারে, কিন্তু আসিফা নয়।
আমরা সাধারণ বাড়ির মায়েরা রাজনীতি, আইন কোনওটাই তেমন বুঝি না। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, এটা এমন এক নির্যাতনের ঘটনা যেখানে নির্যাতনকারীদের পক্ষে মিছিল বের হয়। নির্যাতনকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে— এই ঘটনা আমাদের উপমহাদেশের ঐতিহ্যে নতুন নয়। কিন্তু তাদের সপক্ষে মিছিল? যাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কৌঁসুলি পাওয়ার কথা নয়, তাদের বিপক্ষে কৌঁসুলি পাওয়া সম্ভব হয় না বহু দিন। কাশ্মীর রাজ্যের বার কাউন্সিলের এক জনও উকিল আসিফার পক্ষ নিয়ে কেস লড়ার জন্য রাজি হয় না। এমনকী, আসিফার নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কেস লড়তে অস্বীকার করে বার কাউন্সিল দু’দিনের ধর্মঘটও ঘোষণা করে। সুপ্রিম কোর্টকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয় এবং তীব্র ভর্ৎসনা করে স্বতঃপ্রণোদিত নোটিস পাঠাতে হয় কাশ্মীরের বার কাউন্সিলকে। এখন আসিফার পক্ষে মহিলা কৌঁসুলি যিনি, তাঁর বদলি, জীবনের হুমকি ইত্যাদি তো আছেই।
কারণ? কারণ আসিফা কাশ্মীরী? নাকি আসিফা সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী? নাকি আসিফা দরিদ্র, যাযাবর শ্রেণির মুখ? কোনটা কারণ?
মন্দির (বা দেবস্থান যা-ই হোক) এবং একটি আট বছরের বাচ্চা মেয়ের নির্যাতনের চিহ্ন হিসেবে পড়ে থাকা চুলের অংশের বীভৎসতা (বাকি চিহ্ন আমরা জানি চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে ধুয়েমুছে গেছে) আমাদের আতঙ্কিত করে। আসিফার সমর্থনে সম্প্রতি কলকাতার সংখ্যালঘু প্রধান এলাকা থেকে বেরোনো মিছিলের গঠন আমাদের আতঙ্কিত করে। আমরা সেই মিছিল দেখি, বাড়ি ফিরে অন্য কোন প্রতিবাদের অংশ হতে পারি সেটা ভাবি। কিন্তু ওই মিছিলে পা মেলাতে পারি না। বলতে চাই যে, আসিফার মতো, ঠিক আসিফার মতো মেয়ে আছে আমাদের বাড়িতে। কিন্তু, চাইলেও, সে কথাটা বলতে পারি না।
আমরা ভয় পাই। অনুতাপের চিহ্নহীন পাথরকঠিন সাঞ্জিরামের মুখ দেখে ভয় পাই। আবার মিছিলের ওই মুখ, ঠিক নামাজের পরে পরে, আমাদের শঙ্কিত করে। সদ্য আসানসোল দেখেছি আমরা। জানি একটা মাত্র ফুলকি ছারখার করতে পারে সব কিছু। সেই মৌলবির মতো হৃদয়, সাহস নেই আমাদের। আমরা নিতান্তই সাধারণ।
তবু কোনও মতে উচ্চারণ করি, আসিফা আমাদেরও কেউ হতে পারত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy