Advertisement
১১ মে ২০২৪

রং নেই, আছে আবির আর পলাশের মালা

বাঙালির দোল উৎসবের এক নিঃশব্দ বিবর্তন, যা একমাত্র প্রত্যক্ষ করা যায় রবীন্দ্রনাথের এই শান্তিনিকেতনেই। হোলির দিনে যখন দিকে দিকে উদ্দামতা, শান্তিনিকেতনে তখন সুশৃঙ্খল আনন্দগান ও নাচের অনুষ্ঠান। লিখলেন সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়।শান্তিনিকেতনের এক নিজস্ব নেশা আছে। বহু মানুষ প্রতি বছরই আসেন বসন্তোৎসবে।

শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব। ফাইল চিত্র

শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯ ০৮:০৩
Share: Save:

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, তবু দোলে আসা চাই শান্তিনিকেতনে। কিন্তু কেন? শুধুই কি হুজুগ, বাগানবাড়ির গান? লালমাটির বুকে বিশেষ সুধাপান?

মনে হয় না। আসলে শান্তিনিকেতনের এক নিজস্ব নেশা আছে। বহু মানুষ প্রতি বছরই আসেন বসন্তোৎসবে। তাঁরা পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে এই বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান দেখেন, ছবি তোলেন এবং তার পরবর্তী বিভিন্ন দলের আনন্দ অনুষ্ঠানে শামিল হন। তাঁদের অনেকেই এই ধর্মনিরপেক্ষ আনন্দ-অনুষ্ঠান দেখার পরে নিজের শহর বা মহল্লায় আর দোলে থাকতে পারেন না। রুচির বিরোধ হয়। এখানেই সার্থকতা শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের।

কিন্তু, সব চেয়ে বড় সাফল্য বোধহয়, বাঙালির দোল উৎসবের এক নিঃশব্দ বিবর্তন, যা একমাত্র প্রত্যক্ষ করা যায় রবীন্দ্রনাথের এই শান্তিনিকেতনেই। হোলির দিনে যখন দিকে দিকে উদ্দামতা , শান্তিনিকেতনে তখন সুশৃঙ্খল আনন্দগান ও নাচের অনুষ্ঠান। সকালে সবাই গাইছে , ‘‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল ...।’’ ধর্মের ছুঁতমার্গ, সামাজিক বিধিনিষেধ বা লোকাচারের বাড়াবাড়ি— এর কিছুই আসতে পারেনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে, শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে। এই উৎসব এখনও আন্তরিক, এখনও অমলিন আনন্দের উৎস।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কেউ কেউ মনে করেন, ১৯০৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, বসন্তপঞ্চমীতে, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে, যে ঋতু উৎসবের সূচনা হয়, তারই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ শান্তিনিকেতনের আজকের এই বসন্ত উৎসব বা বসন্তোৎসব। সরস্বতীর পূজার দিন শুরু হলেও পরবর্তী কালে সে অনুষ্ঠান বিভিন্ন বছর ভিন্ন ভিন্ন তারিখ ও তিথিতে হয়েছে। শান্তিনিকেতনের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের বিদেশযাত্রা বা অন্য আরও দিক মাথায় রেখে কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে আশ্রমবাসী মিলিত হতেন বসন্তের আনন্দ অনুষ্ঠানে।

ক্ষিতিমোহন সেন এবং অন্য সঙ্গীদের নিয়ে সে বার রবীন্দ্রনাথ চিন যাত্রা করছেন দোলযাত্রার দিনে। সন্ধ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ ও গঙ্গাতীরের গ্রামের কীর্তনের সুর তাঁকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল। তাই হয়তো, শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব পূর্ণতা পায় রঙের উৎসব ‘হোলি’ বা ‘হোরী’ খেলার দিনে অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের ‘দোলযাত্রা’ তিথিতে। কিন্তু, শান্তিনিকেতনে কখনওই ধর্মীয় আচার অনুষঙ্গ অনুমোদন পায়নি। অথচ উৎসবের আনন্দে ঘাটতিও পড়েনি। দুর্গাপুজো এড়িয়ে শারদোৎসব, বিশ্বকর্মাকে সম্মান দিয়ে শিল্পোৎসব— বাংলাভাষা ও সমাজে শান্তনিকেতন নতুন শব্দ ও ভাবনার সংযোজন করেছে। নববর্ষের দিন শ্রীগণেশ বা এলাহি ভরসা, আমপাতা-সিঁদুর-পঞ্জিকা, হালখাতা আর লাড্ডু ছাড়াও যে নববর্ষ পালন হতে পারে, সেটা শিখিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন। আজকের বাংলাদেশ সেই ধর্মীয়-অনুষঙ্গহীন অনুষ্ঠানকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান-বিবর্তন হল এই বসন্তোৎসব।

‘মৃচ্ছকটিক’ অনুসারী ‘উৎসব’ ছবির বসন্তসেনা আমাদের যে বসন্ত উৎসবের ছবি উপহার দেয়, তা যৌবনের আবিররাঙা। প্রাচীন কাব্যে, ঠুংরি-গীতে, রাজস্থানী-কাংরায় ছবিতে প্রায়ই চপল যৌবনের জয়গান হয়েছে এই হোলিখেলাকে কেন্দ্র করে। উদার বা কুটনীতিক মুঘল বাদশা হোরীখেলার মাধ্যমে যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছেন। লখনউ নগরীতে কবি-নবাব সখীবেষ্টিত হয়ে বৃন্দাবনী হোলিখেলাকে অনুকরণ করেছেন। মথুরার লাঠমার হোলিখেলায় ঘোমটাপরা রমণীরা লাঠি মেরে চলে পুরুষের মাথা লক্ষ্য করে, আর পুরুষদল আজও ঢালের তলায় মাথা লোকায়। দর্শক ছুটছে সেই মজা লুটতে। পাটনা-দানাপুর-আরা হোলির দশ দিন আগে ফাগুয়া গায় আর মৃদু বাসন্তী রং দেওয়া থেকে শুরু করে কালিঝুলি-বাঁদুরে রং-পাঁক মেখে হোলির দু-তিন দিন পরে শান্ত হয়।

আমাদের গ্রামবাংলার নিজস্বতা ছিল দোলযাত্রার সঙ্কীর্তনে, মালপোয়া আর লাল-হলুদ-সবুজ চিনির মঠে। রাধাগোবিন্দের পায়ের আবির, মৃদঙ্গ-শ্রীখোলে ঠেকিয়ে গ্রাম্য বৃদ্ধ বৈষ্ণব গেয়ে উঠতেন, ‘‘গৌর এসো হে ...’’। যুগাবতার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মও এই দোলপূর্ণিমায়। ও দিকে, বর্ধমানের মারোয়াড়ী রাজা বা দেওয়ানদের কল্যাণে ‘হোলি হ্যায়’ বলে উল্লাস করতেও বাঙালি দেরি করেনি। কলকাতা শিল্পাঞ্চলের ‘ছাপড়াইয়া’ হোলিখেলাকে শহুরে হুজুগপ্রিয় বাঙালি, ‘হোলি ছ্যা রা রা রা’ বলে অনুকরণ করেছে। মজা দ্বিগুণ করতে, বেনারসের ‘ভাঙ’, ইংরেজদের ‘বিলিতি’ বাঙালি আত্মসাৎ করেছে। ধর্মীয় সঙ্গীত আর বৈঠকি গান থাকলেও বাঙালির রাস্তায় নেমে আনন্দ করার মতো সার্বজনীন গান তেমন নেই। তাই উত্তর ভারতের হোলির উদ্দামতা এক সময় গ্রাস করে নাগরিক বাঙালিকে।

হোলির শান্তিনিকেতন কিন্তু এ সব থেকে অনেক দূরে। হোলির আগের সন্ধ্যায় যখন অন্যত্র হোলিকা দহন অনুকরণে নাড়াপোড়া বা মেড়াপোড়া হচ্ছে, শান্তিনিকেতনে তখন অশোক-পলাশের রাঙাহাসিকে সাক্ষী রেখে হয়তো গাওয়া হয় ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে...’। দোলের জন্য সব থেকে পুরনো জামাকাপড় পড়ে রং খেলতে যাওয়াই যখন দস্তুর, তখন বসন্তোৎসবের শান্তিনিকেতনে নারীপুরুষ সকলে আবরণে-আভরণে সেজে ওঠে এক রঙে একই ঢঙে। সে রং প্রকৃতির। বসন্তের কচিপাতা উঠে আসে মেয়েদের জোড়া উত্তরীয়ের সবুজে। পলাশের আগুন ছোঁয়া দেয় কপালের আবিররেখায়। সে ঢঙে গুজরাটের ‘ডান্ডিয়া’ মাচ মেশে মণিপুরী রাসনৃত্যে। জাভার 'বাটিক' মেশে রাজস্থানী 'বাঁধনীতে'। এখানে তালপাতার নৌকায় আসে গুলাল বা আবির। বালতি ভরা গোলা বেগুনি রং, দু’হাতে মাখা বাঁদুরে রং, বেলুন-পিচকারি এ সব কিছুই নেই শান্তিনিকেতনে। আছে পলাশের মালা, ফুলের গয়না, শান্তিনিকেতনী সাজের নিজস্ব ঘরানা।

রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে রচনা করেছেন নাটক, কবিতা, নৃত্যোপযোগী গানের রাশি। মূল অনুষ্ঠানের উপযোগী গানের সঙ্গে আনন্দনৃত্য, সন্ধ্যায় নৃত্যনাট্য, খোলা মঞ্চের পিছনে বাসন্তিকা ফুলের ফাঁকে পূর্ণচন্দ্র— সম্ভার সাজানো থরে থরে। মূল অনুষ্ঠান মঞ্চে যখন গাওয়া হয় ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার, রাঙিয়ে দিয়ে যাও' তখনই আবিরের বটুয়ায় হাত পড়ে, আর 'যা ছিল কালো,ধলো'.... শুরু হতেই বাতাসে ওড়ে আবীর। এই সংযম, শালীনতা বিরল। মঞ্চ থেকে অনুষ্ঠানের সুর ছড়িয়ে পড়ে আম্রকুঞ্জের কোণে কোণে, ভবনে ভবনে। সেখানে পাঠভবনের সদ্য কিশোরী অবাক হয়ে দেখে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক সত্তোরোর্দ্ধা কি অনায়াস ভঙ্গিতে নেচে চলেন সমবেত সঙ্গীতের সাথে। পঞ্চাশোর্ধ্ব যুবক সবাইকে ছাপিয়ে গেয়ে ওঠেন, 'ও ভাই কানাআআই, কারে জানাই, দুঃসহ মোর দুঃখ..' শান্তিনিকেতনের দ্বার সকলের জন্য অবারিত। তাই আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুযোগ হয়েছে দোলে শান্তিনিকেতনে আসার। বসন্তোৎসবে পা ফেলারও উপায় থাকে না শান্তিনিকেতনে। স্বাভাবিক ভাবেই এক সময় হুজুগের ভিড়ে আমোদপ্রিয় ‘শহুরে অসভ্যতা’ও ঢুকে পড়েছে। আম্রকুঞ্জের ভিড়ে ডাল ভেঙে পড়েছে। গৌরপ্রাঙ্গণের মঞ্চে অনুষ্ঠানের স্থানান্তর হলেও ভিড় কমেনি। আশ্রমমাঠের বিস্তারও কখনও অপ্রতুল মনে হয়েছে, পৌষমেলার বড়মাঠে যেতে হয়েছে, দোল ছাড়া অন্য কোনও দিন বসন্ত উৎসব করার কথাও ভাবা হয়েছে। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে রেল থেকে হোটেল, ব্যবসায়ী থেকে মিডিয়া, বাউল থেকে বহুরূপী কিংবা সোনাঝুরি থেকে ঝালমুড়ি— সব কিছু জড়িয়ে গিয়েছে। আজ বাস্তবতার কারণেই, সুদীর্ঘ নাচের দলের সদস্যসংখ্যার থেকেও অনেক বেশি থাকেন পুলিশকর্মী।

'শান্তিনিকেতনী দোলযাত্রা' আজ আপামর বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের মুখ। সমস্ত বাংলাভাষী মানুষের আবেগের চাপ সহ্য করতে হয় শান্তিনিকেতনকে। তবু আজও শান্তিনিকেতনের ভাল লাগে, যখন অনেক ছোট ছোট শান্তিনিকেতন এক সঙ্গে এক নিঃশব্দ উত্তরণ ঘটায় বাঙালির রুচিতে, মননে, আচার ও আচরণে।

(লেখক বর্তমানে বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিক, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Basanta Utsav Santiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE