Advertisement
১৬ মে ২০২৪

কে কার হাত ধরবেন?

পরবর্তী নেতৃত্বের প্রশ্নে (মুখ্যত বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ধবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিফল হয়ে) ভাইপো রাজ দল থেকে বেরিয়ে যান ২০০৬ সালে।

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৭
Share: Save:

দাভোসে বিশ্ব আর্থিক ফোরামে নরেন্দ্র মোদী আত্মবিশ্বাসী গলায় ভারতীয় অর্থনীতির উত্থানের জয়গান শোনাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) ও বিশ্ব-অর্থনীতির অন্যান্য নিয়ন্ত্রকদের সম্মেলনের আগে-করা ভবিষ্যৎ-বাণী, ভারতে অচিরেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭.৪% থেকে ৭.৮% হবে, মোদীজির গলায় বাড়তি উৎসাহ সঞ্চার করে থাকবে। তাতে ভর করেই তিনি নানা দেশের হাই প্রোফাইল শ্রোতাদের বলে চললেন, কীভাবে তাঁর সরকারের উদ্যোগে গৃহীত নানা আর্থিক সংস্কার বিভিন্ন নির্বাচনে জনগণের ‘অনুমোদন’ পেয়ে চলেছে। অর্থাৎ, সফল অর্থনীতির পিছনে রয়েছে শক্তপোক্ত রাজনৈতিক সমর্থন ভিত্তি।

যে-সময় মোদী দাভোসে তাঁর সাফল্যগাথা শোনাচ্ছেন সে-দিনই, তার কিছু আগে, তাঁর দল, ভারতীয় জনতা পার্টির সবচেয়ে পুরনো সহযোগী শিবসেনা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, তারা বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক জোট ছিন্ন করল, আগামী লোকসভা ভোটে (২০১৯) তারা বিজেপির হাত ছেড়েই লড়বে। এই ঘোষণার ব্যঞ্জনা সুগভীর। ১৯৮৯ সালে যখন এই দুটি দল পরস্পরের হাত ধরে তখন তারা নিজেদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ বলেছিল। দুটি দলেরই ডিএনএ-তে আছে হিন্দুত্বের মতাদর্শ, যার পিছনে ছত্রপতি শিবাজি সঞ্চারিত মরাঠি (হিন্দু) অস্মিতা (যা বিজেপির উৎসস্বরূপ ও সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এরও চিন্তার কেন্দ্রভূমি) ও তীব্র পাকিস্তান/ মুসলিম বিরোধিতার অনুঘটক ছিল।

শেষোক্ত ‘গুণে’ অবশ্য শিবসেনা বিজেপিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তখন শিবসেনার বেতাজ বাদশা বাল ঠাকরে, ষাটের দশকে যাঁর চোখা কার্টুনে প্রভাবিত, দক্ষিণীদের কাছে চাকরিসহ নানা প্রতিযোগিতায় নাজেহাল মুম্বইবাসী (তখন বম্বে) সদ্য প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক দলটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। ধীরে ধীরে দক্ষিণী-বিরোধিতা পরিবর্তিত হয়েছিল পাকিস্তান/মুসলিম-বিরোধিতায়। মুখ্যত মুম্বইবাসী ‘মাওয়ালি’ ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সমর্থনে পুষ্ট শিবসেনা তখন আজ ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচের পিচ খুঁড়ছে, তো কাল বাম ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পেটাচ্ছে। অন্য দিকে, নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে কেন্দ্রসহ নানা রাজ্যে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বিজেপির হিন্দুত্ব শিবসেনার চোখে ‘নরম’ হয়ে আসছিল। তবু, কংগ্রেস-প্রধান মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসতে শিবসেনা-বিজেপির জোট অনিবার্য ছিল, যা ১৯৯৯ সালে শরদ পওয়ার কংগ্রেস ভেঙে এনসিপি গড়ার পর, ক্ষমতায় আসে। জোটে কিন্তু তখনও ‘বড়দাদা’ বাল ঠাকরের শিবসেনা।

ধীরে ধীরে সেনার সংসারে ফাটল ধরে। পরবর্তী নেতৃত্বের প্রশ্নে (মুখ্যত বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ধবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিফল হয়ে) ভাইপো রাজ দল থেকে বেরিয়ে যান ২০০৬ সালে। আর ২০১২ সালে ‘সেনা’পতির জীবনাবসান। সেনার এই মুহ্যমান দিগ্ভ্রান্ত বেলায় মহারাষ্ট্রে, এবং নরেন্দ্র মোদীর অভিষেকের সর্বভারতীয় অভিঘাতে, বিজেপিই বড় হয়ে উঠতে থাকে। ২০১৪-র নির্বাচনে পৃথক লড়ে বিজেপির চেয়ে অনেক খারাপ ফল করে কোনও মতে (বিজেপির পূর্ণ গরিষ্ঠতা না থাকায়) বিজেপির সঙ্গে জোটে সরকার গড়ে। কিন্তু প্রথম থেকে তাদের সঙ্গে দেবেন্দ্র ফ়ডণবীশ সরকারের সঙ্গে ফাটল চওড়া হয়েছে, কৃষকদের হাল, সেচ নীতি থেকে নোটবন্দি— সব বিষয়েই মতান্তর বেড়েছে। অবস্থা এমনই যে মাঝে মুম্বইয়ে প্রবাসরত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে, ‘দিদি’র একরাশ প্রশংসা করেছেন উদ্ধব। যদিও ভাষ্যকারদের মতে, মহারাষ্ট্রে বিজেপির কাছে ক্রমশ রাজনৈতিক জমি হারাতে হারাতে ‘সেনা’র হতাশা কত গভীর, এই সাক্ষাৎকার তারই প্রমাণ!

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দুত্ববাদী দুই দলের বিচ্ছেদের (যদি আবার মিলমিশ না হয়) ফলে যদি কংগ্রেস বিজেপির ক্ষতি অতএব তাদের লাভের স্বপ্ন দেখে, সেটা কিছুটা আকাশকুসুমই হবে। কেন-না, তাদেরও জোটের অঙ্কে বিপুল অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশা। যেমন, উত্তরপ্রদেশে গত বিধানসভা ভোটে, সমাজবাদী পার্টির (সপা) সঙ্গে ‘শত্রুতা’ ও নিজেদের ব্রাহ্মণপ্রধান ভোটব্যাংকের কথা না ভেবে রাহুল গাঁধী অখিলেশ যাদবের হাত ধরেছিলেন। ভোটে এই জোটের মারাত্মক পরিণামের কথা সবারই জানা। পরে, শোচনীয় হারের ময়না তদন্ত করে সপা নেতৃত্ব এই ফলাফলের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোটকেই দায়ী করেন। এরই মধ্যে অখিলেশ এক ধাপ এগিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে (২০১৯) কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের কোনও জোট হবে না। সম্প্রতি গুজরাতে তুলনামূলক ‘সাফল্য’ পেয়ে যখন রাহুল এবং তাঁর অত্যুৎসাহী সমর্থকরা সামনের লোকসভায় এমনই ‘ধামাকা’ দেখাবেন ভাবছিলেন, তখন সেই উৎসাহ-অগ্নিতে অখিলেশের সরে যাওয়া বারিবর্ষণের কাজই করবে।

তবে রা গা-র সঙ্গে আছে কে? ইউপি-র প্রবচন: মায়াবতী ও মুলায়মের সমর্থন কখন কোন দিকে কী যুক্তিতে হেলবে, ঈশ্বরও জানেন না! ওডিশার নবীন পট্টনায়ক, দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবাল আগামী লোকসভায় কোন দিকে থাকবেন? এবং বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন দিকে থাকবেন? বিরোধীদের মধ্যে কংগ্রেসের পরেই লোকসভায় সাংসদ সংখ্যা তৃণমূল কংগ্রেসের। গুজরাতের ফলে বিজেপির অস্বস্তি বাড়ায় মমতা খুশি নিশ্চয়ই, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর দল লোকসভার ভিতরে ও বাইরে সচেতন ভাবে বিভিন্ন প্রতিবাদের বিষয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব রাখছে। কারণ, মমতার অনুগামীরা তো বটেই, অন্য রাজ্যেরও কিছু বিরোধী নেতা মনে করেন, ২০১৯ সালে বিজেপি-বিরোধী ফ্রন্ট হলে কংগ্রেসের বাইরের যে-সব নেতানেত্রীর নেতৃত্ব দানের সম্ভাবনা, মমতা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আরও প্রশ্ন, এখনও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-তে থাকলেও শরদ পওয়ার কী করবেন?

শিবসেনা যদি ভবিষ্যতে মহারাষ্ট্রে বিজেপির হাত পুরোপুরি ছাড়ে এবং তাতে যদি বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হয়, তবে অনেকের ধারণা, শরদ পওয়ারের এনসিপি সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। গত নির্বাচনের পর ‘সেনা’ যখন বিজেপিকে লেজে খেলাচ্ছিল, পওয়ার ‘সাহায্যের হাত’ প্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ-বারও গুজরাতে জোর রটনা ছিল, যদি বিজেপি গরিষ্ঠতা থেকে সামান্য কিছু কমও পায়, ইউপিএ থেকে এনসিপি বেরিয়ে বিজেপিকে বাঁচাতে পারে। যদিও নদীর স্রোতের মতোই রাজনীতিও বহতা (বিশেষত, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে) ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থানও পালটে যায়। ফলে, কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্নের ‘ঝোপ’ আছে বুঝে এই মরাঠি নেতা ‘কোপ’ মেরেছেন। প্রজাতন্ত্র দিবসেই সব বিরোধীদের নিয়ে ‘সংবিধান বাঁচাও’ মিছিলের আহ্বান করে দারুণ সাড়া পেয়েছেন। কংগ্রেস, তৃণমূল, বামপক্ষ, এমনকী গুজরাতের তরুণ পাতিদার নেতা হার্দিক পটেল অবধি যোগ দিয়েছেন। অস্যার্থ, বিরোধী নেতৃত্বদানের প্রশ্নে নিজের নামটাও ভাসিয়ে রাখলেন।

শাসক ও বিরোধীদের জোট নিয়ে আলোচনায় কেউই সিপিএম নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করছেন না। কারণ, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বিরোধী! শ্যাম না কুল, কেরল না বঙ্গ, বিজেপি বেশি খারাপ না কংগ্রেস, এ-সব প্রশ্নেই এই দলের নেতা-কমরেডরা ইদানীং বেশি কালাতিপাত করছেন। ১৮৭০-এর দশকে ফরাসি মার্কসবাদী কর্মীদের কাজকর্মে বিরক্ত মার্কস লাফার্জকে বলেছিলেন, ‘এটুকুই জানি, আমি মার্কসবাদী নই!’ জন্মের দুশো বছর বেঁচে থাকলে মার্কস হয়তো বলতেন, ভাগ্যিস আমি সিপিএম নই!

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE