Advertisement
১০ মে ২০২৪

চেনা ছন্দ ছেড়ে বাঙালি বদলে যাচ্ছে ঘরে-বাইরে

বিয়ের দিন বেনারসি পরা বাঙালি বধূ চোখে পড়লেও বৌভাতের দিন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেনারসি নিঃশব্দে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা-চোলিকে। লিখছেন শালিনী ভট্টাচার্যবিয়ের দিন বেনারসি পরা বাঙালি বধূ চোখে পড়লেও বৌভাতের দিন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেনারসি নিঃশব্দে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা-চোলিকে।

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৫
Share: Save:

পরিবর্তন কালের নিয়ম। আর এই অমোঘ নিয়মে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধের চেনা চেহারাও। বদলে যাচ্ছে বাঙালি।

আসুন একবার দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ আমলের বাঙালি সমাজ। প্রতিষ্ঠিত বড়দা সংসারের কর্তা। তাঁর অর্থে চসছে গোটা পরিবার। নিজের সন্তান আর ভাইয়ের সন্তানদের একই চোখে দেখেন তিনি। সংসারে রোজগেরে ভাই আর বাউন্ডুলে ভাই দু’জনেরই সমান মর্যাদা। এখন বাঙালি সমাজে এই চিত্র বিলুপ্ত না হলেও বিরল।

বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার শহুরে বাঙালি সমাজে প্রায় নেই বললেই চলে। গাঁ-গঞ্জে এখনও হয়তো কিছুটা আছে। একান্নবর্তী পরিবারে চিরদিনই সকলের মধ্যে কি সদ্ভাব ছিল? কখনই নয়। আগেকার দিনের মানুষ কি স্বার্থ-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতেন না? নিশ্চয়ই হতেন। কিন্তু স্বাধীনতা পূর্বের বাঙালি সমাজে আত্মকেন্দ্রিকতা, অর্থ সর্বস্বতা এখনকার মতো এত অশালীন ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি।

সামাজিক কাঠামোর অনেক বদল ঘটেছে। সবাই একসঙ্গে পুরনো বাড়িতে থাকার চেয়ে দু’তিন কামরার সুবিধাজনক, আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িতে বাঙালি এখন বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। বাঙালির মানসিকতার ও বদল ঘটেছে। ‘দুধে ভাতে’ সন্তানকে রাখতে চাওয়া বাঙালি এখন আর কেবল সাচ্ছল্যে সন্তুষ্ট নয়। বিলাসিতার সমস্ত উপকরণ তার চায়। বাঙালি সমাজে চিরকাল জ্ঞান ও গুণের কদর ছিল। এখন অনেক ক্ষেত্রেই যার যত অর্থ তার তত সম্মান।

বাঙালি আর ঘরকুনো নয়। জীবিকার প্রয়োজনে বাঙালি এখন সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। প্রত্যক্ষ ভাবে কিংবা সিনেমা, টিভির সৌজন্যে বাঙালি নানা সংস্কৃতির মানুষের সংস্পর্শে এসেছে। ফলে নিজের সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ ভাবা বাঙালি এখন অন্যের সংস্কৃতি আত্মস্থ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন বাঙালি চরিত্র সম্বলিত সিরিয়ালগুলির কথা মনে করুন। সেখানে বাঙালি বিয়ের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সুন্দর ভাবে উপস্থিত হয়। কিন্তু বাস্তবে আলতার জায়গা নিয়েছে মেহেন্দি। কোনও কনের হাতের আঙুলের ডগা আর আলতায় চিত্রিত থাকে না। কনের আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত মেহেন্দির কারুকার্য। পায়েও মেহেন্দি। বিয়েতে সঙ্গীত-এর আয়োজন। এখন আর কেউ ঘরের দরজা আটকে বর পক্ষের কাছে টাকা চায় না। বরং ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ সিনেমার আদলে বরের জুতো লুকোয়। বিয়ের দিন বেনারসি পরা বাঙালি বধূ চোখে পড়লেও বৌভাতের দিন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেনারসি নিঃশব্দে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা চোলিকে।

আর বিয়ের মেনুতেও এসেছে পরির্বতন। শুক্তো, পাঁচ তরকারি, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল এখন ব্রাত্য। চাইনিজ, মোগলাই আর বিভিন্ন অবাঙালি খাবারের ভিড়ে বাঙালি খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। বিয়ের আয়োজনে ঠাকুর, হালুইকরের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। গ্রামেও এখন অজস্র ছোট-বড় ক্যাটারার ভোজের আয়োজনের জন্য তৈরি। আমাদের ছোটবেলায় দেখা বিভিন্ন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দেখা মেনু তো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। লুচি, ছোলার ডাল, লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা এখন আর চোখে পড়ে না।

বাঙালির সংস্কৃতি চর্চাতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেকেই আর ধৈর্য ধরে বছরের পর বছর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করতে চায় না। বরং কোনও রকমে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠটুকু নিয়ে হাজির হতে চায় বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো-তে। কত্থক, ভারতনাট্যম, ওডিশি নৃত্যের চল ছিল। এখন এগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন নৃত্য শিক্ষকদের ওয়েস্টার্ন নৃত্যশৈলীতেও পারদর্শী হতে হচ্ছে। নইলে কদর কমছে।

পোশাকের ক্ষেত্রে তো যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গিয়েেছ। মেয়েরা উৎসবে, অনুষ্ঠানে, এমনকি কাজের জায়গাতেও শাড়ি পরা ধরে রাখলেও ধুতি পরা বাঙালি পুরুষ আর কটা চোখে পড়ে? পাঞ্জাবির জায়গা অনেকখানিই কেড়ে নিয়েছে শেরওয়ানি, ইন্দো-ওয়েস্টার্ন পোশাকগুলি। পরিবর্তন ঘটেছে অভিভাবকদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ব্যবহারেও। বঙ্কিমের ‘ব্রজেশ্বরকে’ মনে আছে? প্রফুল্লকে বেজায় পছন্দ হলেও বাবার ভয়ে তাকে সে নিজের জীবনে ও গৃহে জায়গা দিতে পারেনি। এখন পিতা-মাতা-সন্তান মানসিক ভাবে অনেক কাছাকাছি এসেছে। অহেতুক ভয়-ভক্তির জায়গা কেড়ে নিয়েছে ভালবাসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। বাবা-মায়ের ভয়ে কম্পমান সাবালক বাঙালি পুরুষ এখন আর নেই বললেই চলে। সুতরাং বলা যায় সাধারণ বাঙালি পুরুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেছে অনেকখানি।

জীবনযাপনের চাপে বাঙালির আড্ডা দেওয়ার অবসর কমে গিয়েছে। বেকার ছেলেরা সকাল-সন্ধ্যা বাড়ির রোয়াকে অথবা চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে—এ দৃশ্য আজকাল চোখে পড়ে না। বাঙালি এখন শুধু কেরানি হওয়ার শিক্ষা নেয় না। অত্যন্ত স্মার্ট, বুদ্ধিমান, তুখোড় ইংরেজি জানা বাঙালি এখন কর্পোরেট জগতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছে। নীললোহিতের মতো বাউন্ডুলে, কথায় কথায় দিকশূন্যপুর চলে যেতে চাওয়া বাঙালি যুবক এখন কোথায়? সুতির পাঞ্জাবি-পাজামা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উদাস চোখের বাঙালি যুবক এখন বিরল। জিনস্-জ্যাকেটে, বিরাট কোহলি হেয়ার স্টাইলে, ট্রিম করা দাড়িতে তারা এখন ভীষণ ট্রেন্ডি।

রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে বড় হয়ে ওঠা বাঙালি, সুখে-দুঃখে রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুনিয়ে ওঠা বাঙালি, ব্যর্থ প্রেমে কবিতা লেখা বাঙালি এখনও আছে ঠিকই। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের কিরণময়ী দেওর দিবাকরকে নিয়ে সুদূর বর্মায় পাড়ি দিয়েছিল। আর এখনকার বহু বাঙালি বধূ ফেসবুক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ঘর-সংসার ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছে।

বাঙালি মহিলাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও অনেক বদল ঘটেছে। এখন ঘরে ঘরে চাকরিজীবী মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বৈমানিক থেকে বিজ্ঞানী, মহাকাশচারী থেকে শিক্ষিকা সমস্ত পেশাতেই বাঙালি মেয়েরা সফল হয়েছেন, হচ্ছেন। পরিবর্তন ঘটেছে গৃহবধূদের জগতেও। তাঁরা এখন আর সারাদিন হেঁশেলে আবদ্ধ থাকেন না। বাজার, দোকান, সন্তানের পড়াশোনা সবই সামলান নিপুণ হাতে। মা স্কুটি চালিয়ে সন্তানকে বিদ্যালয় অথবা প্রাইভেট টিউটর এর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন— এ তো এখন চেনা দৃশ্য। ‘কুড়িতে বুড়ি’ কনসেপ্টও আর নেই। বাঙালি ললনারা পঞ্চাশ-ষাট বছরেও নিজেদের ছিমছাম ও ফিটফাট রাখতে শিখে নিয়েছেন।

পরিশেষে বলা যায় এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের যুগে বাঙালিও আর নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারছে না। তার জীবনযাপন, চরিত্র, মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটছে। আর এই পরিবর্তন ভাল না মন্দ সেই বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায় যে, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কারণ, পরিবর্তন কালেরই নিয়ম।

শিক্ষিকা, নওপুকুরিয়া জানকীনাথ যদুনাথ উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Culture Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE