তেরো হাজার বাঙালি শ্রমিককে তাড়াইতে চাহে বেঙ্গালুরুর পুর প্রশাসন। ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত ওই পুরসভার মারাটাহাল্লি এলাকায় বস্তির বাসিন্দারা প্রধানত বাংলাভাষী। তাঁহাদের ‘বাংলাদেশি’ বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন সেই রাজ্যের এক বিজেপি নেতা। সংবাদে প্রকাশ, ওই শ্রমিকরা অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ প্রভৃতি জেলার এই শ্রমিকদের প্রমাণপত্রও আছে। অনেকে দীর্ঘ দিন মারাটাহাল্লির বাসিন্দা। ভারতীয় হইবার সুবাদে দেশের যে কোনও স্থানে বাস এবং কাজ করিবার অধিকার সংবিধানই তাঁহাদের দিয়াছে। সেই মৌলিক অধিকারের সুরক্ষাই প্রশাসনের কর্তব্য। ‘অবৈধ’ সন্দেহে বাঙালি শ্রমিকদের কর্মস্থল হইতে উচ্ছেদের অধিকার পুরসভার নাই। মাতৃভাষায় কথা বলিবার জন্য পশ্চিবঙ্গের শ্রমিক ‘বাংলাদেশি’ বলিয়া চিহ্নিত হইতেছেন! তাঁহাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করিতেছে স্থানীয় প্রশাসন। উচ্ছেদেরও বিধি আছে, পুরসভা তাহা মানে নাই। রাতারাতি বিদ্যুৎ সংযোগ কাটিবার ফলে আলো ও জলের অভাবে পাঁচ হাজার শ্রমিক পরিবার বিপর্যস্ত। পুরসভার উচ্ছেদ নীতির বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করিয়াছিল বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি। কর্নাটক হাইকোর্ট সাত দিনের জন্য উচ্ছেদপ্রক্রিয়া স্থগিত করিয়াছে।
অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার নীরব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিতেছেন, বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসা উস্কাইবার চেষ্টা এই রাজ্যে বরদাস্ত করা হইবে না। উত্তম কথা। কিন্তু এই রাজ্যের শ্রমিক যখন ভিনরাজ্যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক এবং প্রাদেশিক বিদ্বেষের শিকার, তখন মুখ্যমন্ত্রী নীরব কেন? গত বৎসর ডিসেম্বরে রাজস্থানে মালদহের শ্রমিক আফরাজুল খানের অমানবিক হত্যার কথা কে ভুলিতে পারে? বিভিন্ন রাজ্য হইতে তখন কয়েক হাজার বাঙালি শ্রমিক প্রাণভয়ে রাজ্যে ফিরিয়াছিলেন। শ্রমিকের ক্ষতবিক্ষত দেহ মিলিয়াছিল গুজরাতে। গত জুলাইয়ে কেরলে গণপ্রহারে প্রাণ হারাইয়াছেন এক বাঙালি শ্রমিক। ভিনরাজ্যে নির্যাতিত, প্রতারিত, দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকদের সংখ্যাও কম নহে। তাঁহাদের নিরাপত্তা বাড়াইবার কোনও উদ্যোগ নাই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত বৎসর ভিনরাজ্যে কর্মরতদের তালিকা ও বিকল্প জীবিকার জন্য অনুদানের ঘোষণা করিয়াছিল। কাজ কী হইয়াছে, তাহার খতিয়ান সরকার জানায় নাই। কত শ্রমিক জীবিকার তাড়নায় অন্য রাজ্যে কাজ করিতেছেন, কত জনই বা সরকারি সহায়তায় রাজ্যে জীবিকার সন্ধান পাইলেন, বুঝিবার উপায় নাই।
ইহা কেবল সরকারি আধিকারিকের কর্মবিমুখতা নহে। ইহা ব্যর্থতা ঢাকিবার চেষ্টা। এই রাজ্যে যে উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ নাই, গ্রাম ছাড়িয়া বাঙালি যে জীবিকার সন্ধানে অন্য রাজ্যে যাইতেছে, সেই সত্য স্বীকার করিতে নেতারা নারাজ। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা গুনিলে শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ, কৃষকের আয়ে আড়াই গুণ বৃদ্ধি প্রভৃতি ‘সাফল্য’ লইয়া প্রশ্ন জাগিতেই পারে। পরিযায়ী শ্রমিকের অস্তিত্বই সরকার স্বীকার করিতে আগ্রহী না হইলে তাহার সমস্যার সমাধান কী করিয়া হইবে? তাই এতগুলি বাঙালি শ্রমিক পরিবার কর্মহারা এবং গৃহহারা হইতে পারেন, তাহা জানিয়াও রাজ্যের সরকার ও তৃণমূল নেতারা নীরব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy