ভোটের অঙ্ক দিয়ে সরকার গড়া হবে, এটা নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রাথমিক নিয়ম। এর ফলে একটা মুশকিল হয়েছে এই যে, নির্বাচনের আলোচনাটা সাধারণত ওই প্রাথমিক নিয়মের গণ্ডি উতরে আর বেরোতে পারে না। এই পাটিগণিত-চর্চা জরুরি। পরিসংখ্যানের আরও গভীরে নেমে বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু ভোটের অঙ্ক আর ভোট এক নয়। পরিসংখ্যানে আমরা নির্বাচনের পরিণামটুকু দেখি; প্রত্যেকটা নির্বাচনের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত থাকে, নিজস্ব প্রক্রিয়া থাকে, যাকে শুধু সেই পরিণাম দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। বিশেষত সেই পরিপ্রেক্ষিত ও প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যখন একটা বড় সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং দানা বাঁধে, তখন সেই নির্বাচনের সামগ্রিক পরম্পরার দিকে মন দিতে পারলে সে এমন অনেক কথা বলে, যা কোনও অঙ্কে ধরা পড়ে না।
যেমন বিহারে এ-বারের বিধানসভা নির্বাচন। তার ফলাফলের সংখ্যাগুলো অবশ্যই অর্থবহ। কিন্তু এই নির্বাচনের তাৎপর্য আরও অনেক বেশি গভীর ও সুদূরপ্রসারী। ভারতের নির্বাচনী (এবং বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক) মানচিত্রে বিহার বরাবরই অনন্য, সে-কথা মনে রেখেও বলতেই হবে, এ-বার সেই রাজ্যে একটি ইতিহাস রচিত হল। সম্ভাবনা সৃষ্টির ইতিহাস। রাজনীতি নির্মাণের সম্ভাবনা। অনুশীলনের মধ্য দিয়েই সেই নির্মাণ সম্ভব। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতির অনুশীলন দেখা গেল, ভোটের হিসেবে তার আংশিক ছবিই মেলে, তার বেশি নয়।
একটা স্তরে এই অনুশীলনের স্বরূপ একটি স্লোগানেই প্রতিফলিত। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মঞ্চ থেকে ধ্বনিত সেই স্লোগানের অর্থ: রোজগার, লেখাপড়া, ওষুধপত্র, সেচের জল। আরজেডি তথা মহাগঠবন্ধন নামক বিরোধী জোটটি জনসাধারণের এই মৌলিক প্রয়োজনের দাবিগুলি নিয়ে প্রবল প্রচার চালিয়ে শাসক গোষ্ঠীর মন্দির-মসজিদ-মার্কা রণকৌশলে বড় ধাক্কা দিয়েছিল, যে ধাক্কা সামলানোর তাগিদে প্রধানমন্ত্রীকে বিহারবাসীর উদ্দেশে আবেগ-আকুল চিঠি লিখতে হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে আকুলতর আবেগে বলতে হয়: ‘এই আমার শেষ নির্বাচন’, এবং শুধু ফাঁকা আবেগে চিঁড়ে ভিজবে না জেনেই তাঁরা বিপুল কর্মসংস্থান থেকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন, নানান প্রতিশ্রুতি বিতরণে বাধ্য হন। ভোটের বাজারে প্রতিশ্রুতি নেহাতই মামুলি ব্যাপার, কিন্তু প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির চাপে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর বাহিনী হিন্দুত্ব ছেড়ে চিঁড়ে ভেজানোর অন্য উপকরণ খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা কম কথা নয়। নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে কী নিয়ে কথা হবে এবং কী সুরে তা বলা হবে, সেটা বেঁধে দিয়েই ওঁরা অর্ধেক যুদ্ধজয় সেরে ফেলতে তৎপর থাকেন। গত লোকসভা নির্বাচন তার সবচেয়ে প্রকট, এবং উৎকট, প্রমাণ। কিন্তু বিহারে তাঁরা নিজেদের অ্যাজেন্ডা বহাল রাখতে পারেননি, কার্যত মধ্যপথে বিরোধীদের তৈরি করে দেওয়া খেলায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। রাজনীতির নির্মাণে এর মূল্য বিস্তর।