Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চোলাইয়ে চাঙ্গা ধানের চারা, উত্তর খুঁজছেন শিক্ষক

আধিকারিকদের কেউ বলছেন, এটা টোটকা। কারও মতে, কিছুটা কাজ হয়। চাষিরা শীতকালে চোলাই বা দেশি মদ প্রয়োগ করে থাকেন বীজতলায়। কারণ কী? উত্তরের খোঁজে আনন্দবাজারজীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক অনুভব বেরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ২ ব্লকের জাহালদায় বাড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মুস্তাফাপুর যশোদা বিদ্যাপীঠের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক।

শীতে বীজতলা চাপা দেওয়া পুরনো পদ্ধতি। নিজস্ব চিত্র

শীতে বীজতলা চাপা দেওয়া পুরনো পদ্ধতি। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫০
Share: Save:

জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক অনুভব বেরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ২ ব্লকের জাহালদায় বাড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মুস্তাফাপুর যশোদা বিদ্যাপীঠের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। স্কুল পটাশপুর ২ ব্লকে। তাঁর বাস, স্কুল এবং আশপাশের এলাকা মিলে দুই জেলার তিনটি ব্লক। গ্রামের রাস্তায় বা স্কুলের সময়ে তিনি দেখেন, চাষিরা খেতে খামারে কাজ করছেন। কেউ বীজতলায়। কেউ আনাজের খেতে। কেউ পানের বরজে। কখনও তাঁদের সার ছেটাতে দেখেন। কখনও দেখেন, ওষুধ দিচ্ছেন চাষিরা। কখনও কখনও গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাও করেন চাষিদের, তাঁরা জমিতে কী দিচ্ছেন। কিন্তু বছর তিন চারেক হল, তিনি লক্ষ্য করে দেখছেন, জমিতে মানে বীজতলায় অনেকে চোলাই বা দেশি মদ ছিটিয়ে দিচ্ছেন।

এরও একটা ইতিহাস রয়েছে। কীটনাশক ছেটালে তার গন্ধ আলাদা। কিন্তু একদিন জমি থেকে মদের গন্ধ ভেসে আসছিল। আর সেটা আসছিল ওই ওষুধ ছেটানোর সময়েই। ব্যাপারখানা কী? অনুভব বেরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন চাষিদের। শীতকালেই চাষিরা এটা করে থাকেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, শীতকালে প্রবল ঠান্ডায় ধানের চারা বাড়তে চায় না। কিন্তু চোলাই বা দেশি মদ গাছে ছেটালে এর চটজলদি ফল মেলে। কুয়াশা বা প্রবল ঠান্ডা হলে এই পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়।

এর কারণ কী? নিজের জীবন বিজ্ঞান শিক্ষার জ্ঞান দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। শীতকালে গাছেরা যে খাবার তৈরি করে তা কি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে কোনও অসুবিধে হয়? এই সময়ে তো প্রচলিত নানা ওষুধই চাষিরা দিয়ে থাকেন। তাহলে কেন নতুন এই পদ্ধতি? চোলাইয়ে যে অ্যালকোহল থাকে তা তো ক্ষতিকর। মানুষেরই ক্ষতি হয়। গাছের চারার তো হবেই। তিনি বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসা করে কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষি আধিকারিকেরা গতানুগতিক উত্তরই দিয়েছেন। তাঁদের কথায়, এই রকম কোনও পরামর্শ সরকারি ভাবে কৃষকদের দেওয়া হয় না। তাঁরা প্রচলিত সার, ওষুধই ব্যবহার করতে বলেন। অনুভববাবু জানালেন, এ বিষয়ে উত্তর পাওয়াটা খুবই জরুরি। চাষিরা এটা শিখলেন কোথা থেকে? এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে? যদি না থাকে তা হলে তা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকরও তো হতে পারে?

এ বিষয়ে সরকারি ক্ষেত্রেও কোনও সঠিক সদুত্তর নেই। তবে জাতীয় জীবন জীবিকা মিশনের জাতীয় উপদেষ্টা কাঞ্চন ভৌমিক বলেন, ‘‘আসলে বিজ্ঞান তো আমরা আমাদের মতো করে আবিষ্কার করি। সেই আদি কাল থেকেই মানুষ নানা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি।’’ তাঁর ব্যাখ্যায়, চোলাইয়ের বিষয়টিতে বিজ্ঞান রয়েছে। চোলাইয়ে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ-সহ ১৭টি মৌল, যা গাছের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তা রয়েছে। এগুলো মানব শরীরকে খুব দ্রুত উত্তেজিত করে। গাছের ক্ষেত্রেও তাই। তিনি জানান, কিছুদিন আগে তাপমাত্রা ভীষণ কম ছিল। ফলে ধানের চারার বৃদ্ধি ঠিকঠাক হচ্ছিল না। আট, নয় ডিগ্রি পর্যন্ত নেমেছে তাপমাত্রা। সেই সময়ে অনেকে সাবেক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। যেমন বীজতলায় পলিথিন চাপা দেওয়া। বা বীজতলা ঘিরে কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া। কিন্তু অনেকেই শক থেরাপির মতো গাছকে চাঙ্গা করতে চোলাই ছিটিয়ে দিয়েছিলেন।

কাঞ্চন ভৌমিক জানাচ্ছেন, চোলাই যদি বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহলে গাছের কাজে লাগে। নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশিয়াম-সহ গুরুত্বপূর্ণ মৌলগুলো পেয়ে থাকে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, মানুষ যেমন রোদে পুড়ে ঘেমে নেয়ে এসে গ্লুকোজের জল খেয়ে তাজা হয়ে নেন, গাছেরাও এই মৌলগুলো পেয়ে সতেজ হয়। তাদের বৃদ্ধি ঠিকঠাক হয়। তবে ঠিক মতো বীজতলায় প্রয়োগ করতে হবে চোলাই। সেটা চাষিরা জানেন না। কাঞ্চনবাবুর মত, এই পদ্ধতি একেবারেই অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।

অনুভববাবু লক্ষ্য করেছেন, পান চাষিরা গুঁড়ো দুধও ব্যবহার করে থাকেন। জলে গুলে বরজে ঢুকে পান পাতায় দেওয়া হয় দুধ। এতেই কি বিজ্ঞান রয়েছে? এ বিষয়ে কাঞ্চনবাবুর মত, এই বিষয়টি চাষিদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে এসে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে যথেষ্ট পান চাষ হয়। নামও রয়েছে এখানকার পানের। এক সময়ে বেশ কিছু রোগ পোকার আক্রমণে চাষ বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। আবার কীটনাশক ব্যবহার করলে বিদেশের বাজারে বেশি দাম মেলে না। সেখানে ভাল কাজ করে গুঁড়ো দুধের মিশ্রণ। এতে পানের পাতা মোটা হয়, চকচকে হয়। স্বাদ ভাল হয়। কিছুটা গন্ধও ভাল হয়। বিজ্ঞানটা হল, দুধের ল্যাকটিক অ্যাসিড পানের পাতায় নানা রাসায়নিক কার্যকলাপে সাহায্য করে।

তবে ঘটনা হল, দুধ বা চোলাই পুরোটাই কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাত্রা এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সেটা চাষিদের অনেকেই জানেন না। তাতে সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাঁর মতে, বিদেশের বাজারে দাম পাওয়ার জন্য চাষিরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

তবে পশ্চিম মেদিনীপুরের উদ্যানপালন বিভাগের উপ অধিকর্তা কুশধ্বজ বাগ জানালেন, পানের পাতায় দুধ দিলে কিছু উপকার হয় কিনা তাঁর জানা নেই। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে কিনাও তিনি জানেন না। বিষয়টি চাষিদের থেকে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কৃষি দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন, বীজতলায় চোলাই প্রয়োগ করেন চাষিরা এমন কোনও তথ্য তাঁদের কাছে নেই। চোলাইয়ে গাছের কোনও উপকার হয় বা এর কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে সে বিষয়েও তিনি জানেন না। কেউ প্রয়োগ করে থাকলে তাঁকে কৃষি দফতর থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Paddy Paddy Field Boro Cultivation Agriculture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE