আজীবন আমেরিকায় বসবাস করলেও জে টি সান্ডারল্যান্ড জন্মসূত্রে ইংরেজ। ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে তাঁর জন্ম। ১৮৪৪ সালে অর্থনৈতিক কারণে তাঁর পরিবার চলে আসে আমেরিকায়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের যাজক হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। এর পর তিনি ইউনিটারিয়ান মতবাদে দীক্ষিত হয়ে সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করেন। ধর্মপ্রাণ হলেও তিনি ছিলেন নির্ভেজাল মানবতাবাদী।
কৈশোর থেকে ভারত সম্পর্কে কৌতূহলী তিনি। মিশনারিদের কাছে এই অদ্ভুত দেশের নানা গল্প শুনতেন। পরে ব্রিটিশ ন্যাশনাল ইউনিটারিয়ান আ্যাসোসিয়েশন যখন তাঁকে ভারতে পাঠানোর প্রস্তাব করে, তিনি সাগ্রহে তা গ্রহণ করেন। ভারত সম্পর্কে ইংরেজদের লেখা বই পড়ে তখনও পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক বলেই মনে করতেন। ভারতে এসে এখানকার মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে, এখানকার পত্র-পত্রিকা পড়ে, ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে, ইংরেজ শাসকদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে, এখানকার সংগঠনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। দেশে ফিরে তিনি ভারতের দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে একটি ছোট পুস্তিকা লেখেন, ‘দ্য কজ়েস অব ফ্যামিন ইন ইন্ডিয়া’। নিউ আটলান্টিক মান্থলি পত্রিকায় লেখেন ‘দ্য নিউ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’ নামে প্রবন্ধ। সান্ডারল্যান্ড প্রথম ভারতে আসেন ১৮৯৫ সালে। ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় বার ভারতভ্রমণের পরে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ধর্মযাজকের পদে থাকলেও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও অপশাসনের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠেন। ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে লেখেন এক বিস্ময়কর বই ‘ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ: হার রাইট টু ফ্রিডম’। এই বই প্রথমে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। তার পর সান্ডারল্যান্ডের বন্ধু, ‘প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-এর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৯২৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন বইটি।
সান্ডারল্যান্ড যে যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলি হল: ১) অন্য জাতিকে শাসন করার অধিকার কোনও জাতির নেই। ২) যে কোনও বিদেশি শাসনের মতো ভারতে ইংরেজ শাসনও অত্যাচারমূলক। ৩) ভারতের মতো ঐতিহ্যশালী দেশকে পদানত করে রাখা অপরাধ, পৃথিবীর শান্তির অন্তরায়; তাই ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ প্রয়োজন। ৪) যে ভারতবাসী গত ৩০০০ বছর ধরে নিজেদের শাসন করেছে, তারা আজও তা করতে পারে, ইংরেজের গায়ে-পড়া অভিভাবকত্বের প্রয়োজন নেই। ৫) একমাত্র ভারতবাসীর হাতেই ভারতবাসীর স্বার্থ সুরক্ষিত থাকতে পারে।
এর সঙ্গে রইল পরাধীন ভারত সম্বন্ধে বিশিষ্ট মার্কিনদের বক্তব্য: অন্য দেশ স্বাধীন হলে ভারত কেন তা হতে পারে না? ভারতের মঙ্গলের জন্যই কি ব্রিটিশরা ভারত শাসন করছে? এর সঙ্গে রইল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার কাহিনি। রইল অমৃতসর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্যও।
তখনকার দিনে সান্ডারল্যান্ডের ‘ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ’ ভারতে খুব জনপ্রিয় হয়। কেউ কেউ এমনকী বইটিকে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাইবেল বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রথম সংস্করণে ২০০০ বই ছাপা হয়েছিল। তা নিঃশেষিত হয়ে গেলে শুরু হয় দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ। টনক নড়ে সরকারের। এমনিতেই সে সময় মেরঠ ষড়যন্ত্র মামলা ইত্যাদি ঘটনায় সন্ত্রস্ত ছিল ইংরেজ সরকার। এর মধ্যে সান্ডারল্যান্ডের বই ভারতীয়দের উত্তেজিত করতে পারে ভেবে সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল।
১৯২৯ সালে পুলিশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকার অফিসে হানা দেয়, ৪৩টি বই বাজেয়াপ্ত করে, রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করে মুদ্রাকর সজনীকান্ত দাসকে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ও গ্রেফতার হন। তার পর শুরু হয় রাজদ্রোহের মামলা। শেষে সজনীকান্ত ও রামানন্দ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পান।
কেবল ভারতে নয়, এই বই ইউরোপ ও আমেরিকাতেও শ্রেণিস্বার্থভোগীদের ভীতির কারণ ছিল। আমেরিকায় বইটি প্রকাশের জন্য সান্ডারল্যান্ড দ্বারস্থ হয়েছিলেন ১৪ জন প্রকাশকের, কেউ রাজি হননি। প্রকাশক পুটম্যান বলেছিলেন লেখক ৬০০০ ডলার দিলে তিনি রাজি, তবে বিজ্ঞাপন তিনি দেবেন না। শেষে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে কোপল্যান্ড বইটি প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ডের এক প্রকাশক প্রথমে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করতে রাজি হয়েও পরে পিছিয়ে যান। প্রকাশকদের এমন আচরণ বিষয়ে রসিকতা করে সান্ডারল্যান্ড বলেছিলেন, ‘‘গ্রেট ব্রিটেন ভারতে যে বই নিষিদ্ধ করেছে সেই বই-এর লেখক আমিই কি না!’’
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy