প্রত্যাখ্যান: বিরোধী পক্ষের জয়োল্লাসে যোগ দিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-র মুখোশ পরে পথে নেমেছেন প্রতিবাদী। লন্ডন, ৯ জুন। রয়টার্স
ব্রেক্সিট জিনিসটা নির্ঘাত একটা ভূতুড়ে ভেলকি। না হলে কি আর তার ঘায়ে একের পর এক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা এই রকম ‘দেখ্ বাবাজি দেখবি নাকি’ দাঁড়ায়! এই তো গত বছরই দেখলাম এক কাণ্ড। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকতেই চায়, এমনটা ধরে নিয়ে আগেকার প্রধানমন্ত্রী গণভোট ডেকে দিলেন, ভাবলেন, এক ঘায়ে ইইউ-বিরোধীদের চুপ করিয়ে দেবেন। ফল হল পুরো ডিগবাজি। গণভোটের সিদ্ধান্ত গেল ব্রেক্সিটের পক্ষে, ইইউ-এর বিরুদ্ধে। বেচারা ডেভিড ক্যামেরন মানে মানে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেন। আবার এ বছর তাঁর উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী গভীর বিবেচনা করে দেখলেন, ব্রেক্সিট তো হচ্ছেই, ব্যাপারটা আর একটু জমিয়ে করা যাক, পার্লামেন্টে নিজের জায়গাটা আরও জোরদার করা যাক। ধাঁ করে দিলেন ভোট ডেকে, ভাবলেন এক ব্রেক্সিট তরী দিয়েই পার্টি এ বার জিতে আসবে ল্যান্ডস্লাইড ব্যবধানে। যেখানে তিন বছর পর ভোট হওয়ার কথা, সেখানে আলেয়ার পিছনে ছুটে বাজি ধরে দুই মাসের মধ্যে ভোট ঠিক করলেন তিনি। এবং বিচ্ছিরি ভাবে হারলেন। শেষ অবধি তিনিই আবার সে দেশে প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখ, কিন্তু সে মুখটা এখন এতটাই পুড়ে ঝুরঝুরে, ব্রেক্সিটের দরাদরিটাই বা তিনি কোন মুখে করবেন, আর কত দিনই বা তাঁর দল এই পোড়ামুখ সহ্য করবে, বলা মুশকিল!
টেরেসা মে-র আনতাবড়ি বাজি আর একটা জিনিসও বুঝিয়ে দিল। ব্রিটেনকে তিনি যে ভাবে একটা বন্ধ দেশ বানাতে চাইছিলেন, সেটা খুব সহজ কাজ হবে না। নানা নীতি দিয়ে তাঁর সরকার অভিবাসীদের কড়া বার্তা দিচ্ছিল, প্রথম প্রজন্মের ব্রিটিশ নাগরিকদেরও ছেড়ে কথা কইছিল না। গোটা সমাজকে নানাবিধ কৃচ্ছ্রসাধনে বাধ্য করছিল। দেখেশুনে ভোটারদের সপাট মতামত: ধীরে, টেরেসা, ধীরে। ব্রিটেন অনেক দিনই নানা-জাতি নানা-বর্ণের দেশ। সমাজ এবং রাজনীতির পরতে পরতে ঢুকে গিয়েছে তার বহু-সংস্কৃতিবাদের শিকড়বাকড়। এ বারের ভোটে সেই বহুত্বের বর্ণচ্ছটাই বেরিয়ে এল, অন্যান্য বারের চেয়ে অনেক বেশি চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে। না হলে কি— যে ম্যাঞ্চেস্টারে এত বড় জঙ্গি হানায় এতগুলি প্রাণ গেল, আর প্রমাণিত হল সেই জঙ্গি আসলে এক ব্রিটিশ মুসলিম নাগরিক, সেই ম্যাঞ্চেস্টারেই আবার ভোটের ফলাফলে একটুও মুসলিম-বিরোধিতা বা অভিবাসী-বিরোধিতার ছাপ না পড়তে পারে? ইতিহাস তৈরি করে জিতে আসতে পারেন অঞ্চলের প্রথম মুসলিম এমপি আফজল খান?
এখানেই টেরেসা মে-র দেশটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশের থেকে আলাদা। মার্কিন সমাজেও কত দেশের কত মানুষ কত দিন ধরে বসবাস করছেন। কিন্তু তাঁদের কত জন ভোটে জিতে পার্লামেন্টে যান? অথচ ব্রিটেনের রাজধানী শহরের মেয়রের নামই সাদিক খান। এই বারের ভোটে জিতে এলেন রেকর্ড সংখ্যক ১২ জন ভারতীয় এমপি। প্রথম শিখ পুরুষ এমপি ও প্রথম শিখ মহিলা এমপি এ বার পা দেবেন পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্রের সৌধে। বেশি বেশি মানুষ এ বার ভোট দিয়েছেন, আগের বারের থেকে ২ শতাংশ-বিন্দু বেড়ে এ বার ৬৮.৭ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। এবং স্পষ্ট হিসেব, যেখানে যেখানে বিরোধী লেবার পার্টি জিতেছে, সেই সব জায়গাতেই ভোটদানের হার ৫ শতাংশ-বিন্দুরও বেশি বেড়েছে। টেরেসা মে-র মন্ত্রিসভার অভিবাসী-বিরুদ্ধতা, সংকীর্ণ জাতীয়তার উদ্ধত প্রচার এই সব তথ্যে নজর রাখতে বাধ্য করছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে, এখনকার ব্রিটিশ সমাজ এখনকার ব্রিটিশ শাসকের দিকে তাকিয়ে কী বলছে। বলছে, ধীরে, বৎসে, ধীরে।
এটাই এই নির্বাচনের প্রধানতম বার্তা। ব্রেক্সিটের পদ্ধতি নিয়েও ধীরে চলতে হবে কি না, সেও এখন লক্ষ-পাউন্ডের প্রশ্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিরা তেমন ‘আশঙ্কা’ই করছেন। আশঙ্কা এই জন্যই যে, ব্রেক্সিট নিয়ে এখনও অবধি যতটা এগিয়ে এসেছে কনজারভেটিভ পার্টির প্রাক্তন সরকার, তাতে তাদের আজকের কোনও-রকমে তৈরি করা ত্রিশঙ্কু সরকার কিন্তু খুব বিলম্বিত লয়ে চলতে গেলে মুশকিল। বাস্তবিক, দেরি যদি হয়, গাঁটছড়া খোলার প্রয়াস যদি দ্রুত না হয়, তাতে কেবল ব্রিটেনেরই সমস্যা নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর সমস্যাও প্রচুর। ব্যাপারটা খোলসা করে বলতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবিধানের ৫০ নম্বর ধারাটা না বললেই নয়। সেই ধারা-মতে, কোনও দেশ যদি ইইউ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, তবে তাকে ঘোষণাটা করতে হবে, এবং ঘোষণার দুই বছরের মধ্যেই বাধ্যতামূলক ভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। দুই বছরের সীমারেখা পার হয়ে গেলেই ইইউ-এর অন্য দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক চুক্তি সই করার কাজটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ বার ঘটনা হল, ভোটের ঠিক দেড় মাস আগে, ২৯ জুন, টেরেসা মে সেই ৫০ নম্বর ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ করে ফেলেছেন, তূণ থেকে তির বেরিয়ে গিয়েছে। সুতরাং ঘড়ির কাঁটাও টিক-টক করছে: কবে ২০১৯-এর মার্চ এসে যায়। নতুন সরকার এলে এমনিতেই কাজেকম্মে খানিক দেরি হওয়ার কথা। তার ওপর ত্রিশঙ্কু পার্লামেন্টে দগ্ধানন প্রধানমন্ত্রী উদ্যমপূর্ণ বিপুলতর বিরোধী পক্ষের বাধা পেরিয়ে চুক্তি-পত্র স্বাক্ষর করবেন কী ভাবে, সেখানেই ঘোর অনিশ্চয়তা। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন, দেরি যদি হয়, ব্রিটেনের হাতে থাকবে লবডঙ্কা: ‘নো ডিল’, ‘নো নেগোসিয়েশনস’। এই আশঙ্কাময়তার মধ্যে লক্ষণীয় হল, লেবার পার্টিকে প্রাণ খুলে ভোট দিয়ে যে ব্রিটিশরা তাদের ২৩২ থেকে ২৬১টি আসনে নিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের এ সব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। লেবার পার্টির ম্যানিফেস্টোয় ব্রেক্সিট বিষয়ে অত্যন্ত কম শব্দ ব্যবহার হয়েছে। আর লেবার পার্টির প্রধান নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ব্রেক্সিটের থেকে অনেক গুরুতর বিষয় ব্রিটেনের তরুণ সমাজ, তাদের জীবনযাত্রা, লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ সুযোগ ইত্যাদি।
করবিনের ভিন্ ধাঁচের ব্যক্তিত্বের টানেই কি না বলা মুশকিল, এ বারের ভোটে তরুণ সমাজের বিপুল অংশগ্রহণ অবাক করে দিল। যে দেশে কেন অল্পবয়সীরা ভোট দিতে চায় না, মে মাস অবধি সেই তর্কবিতর্ক চলছিল, জুন মাসেই সেখানে কি না তরুণ ভোটারদের ঢল নামল? ৭২ শতাংশ বেরিয়ে এসে ভোট দিলেন? ২০১৫ সালে ১৮-২৪ বছর বয়সী সমাজটার মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোট দিয়েছিল! আর এ বার দুই মাস আগে নির্বাচনের ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এই বয়সগোত্রের দশ লক্ষ নতুন ভোটার রেজিস্টার করলেন! ভূকম্প বললে ভুল হয় না! কলেজশিক্ষায় টিউশন ফি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন করবিন, সেটা নিশ্চয়ই আঠারো বছরদের নতুন করে মাথা তুলবার ঝুঁকি নেওয়াতে সফল হয়েছে— আন্দাজ। এও আন্দাজ যে, ব্রেক্সিট নিয়ে বাড়াবাড়িতেও এরা অখুশি। টেরেসা মে-কে প্রত্যাখ্যানই বুঝিয়ে দেয়, ভয়ে ভয়ে আগে থেকেই ঘরের দরজাগুলো বন্ধ করে দিতে এরা নারাজ।
তরুণদের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছেন বয়স্ক ভোটাররাও। ওয়েলস-এ করবিনের নির্বাচনী প্রচারে না কি এমন ভিড় হয়েছে যে সেখানকার মানুষ নিজেরাই বিস্ময়ে হতবাক, এত লোকও থাকে এখানে, জানা ছিল না তো!
কে সরকার গড়বে, কী করে সরকার চলবে, হ্যানাতানা হিসেবের বাইরে তাই এই ভোটের আসল প্রাপ্তিটা বড্ড উৎফুল্ল করে দিচ্ছে। ফ্রান্সের পর আবার ব্রিটেনের ভোট প্রমাণ করল, বন্ধ সমাজ নয়, মুক্ত সমাজ চাই— এই দাবি তোলার স্পিরিটটা তা হলে এখনও কোথাও আছে! সবাই মিলেমিশে থাকলে সমস্যা হতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মিলেমিশে থাকা চাই, এই আদর্শটা তা হলে মরে যায়নি! বিপদ-আপদ তুচ্ছ করার বিরাট দুঃসাহসেরা তা হলে আজও কোথাও উঁকি দিয়ে যেতে পারছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy