E-Paper

কার পরিচয়

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, যদি সত্যিই ভুল জাতিগত পরিচয় দিয়ে থাকেন আত্মঘাতী ছাত্র, তা হলে কেন আর তাঁর নামে আন্দোলনে রাজনৈতিক সমর্থন জানানো?

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৭:৫৮
Rohith Vemula

—ফাইল চিত্র।

কোনও কোনও ক্ষেত্র এমন হয় যেখানে ব্যক্তির গুরুত্ব অপেক্ষা ব্যক্তির মাধ্যমে যে বিষয়টি সূচিত হচ্ছে, তার গুরুত্ব অনেক বেশি বড়। রোহিত ভেমুলার ক্ষেত্রটি সেই রকম। ইতিমধ্যে তেলঙ্গানা রাজ্যের পুলিশ রোহিত ভেমুলার আত্মহননের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির এক সমাপনী রিপোর্ট পেশ করেছে, সেটি তেলঙ্গানা হাই কোর্টে জমা পড়েছে। রিপোর্টে প্রকাশিত রোহিতের আচরণ-অসঙ্গতির কারণে ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সাংসদ মন্দারু দত্তাত্রেয়, বিধায়ক এন রামচন্দর রাও, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাও, কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং এবিভিপি-র কতিপয় নেতা ছাড়া পেয়ে গেলেন এই জন্য যে, তদন্তে প্রকাশিত, রোহিত আসলে তফসিলি জাতিভুক্ত নন, তিনি ‘ভুল’ পরিচিতি দিয়েছিলেন বলেই নাকি ‘ভয়’ তাঁকে তাড়া করে আত্মহননের পথে চালনা করে। জাতিগত শংসাপত্রটি ‘ভুল’ তথ্যের উপর ভিত্তি করে জোগাড় করা হয়েছিল— যে ঘটনায় তাঁর মা রাধিকাও নাকি জড়িয়ে ছিলেন। পুলিশি তদন্ত অনেক সময়ই ঠিক ভাবে ও ঠিক পথে ‘ভুল’ তথ্য প্রমাণ করে না, তবু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় এখানে তদন্তে নিরপেক্ষতার অভাব ছিল না, তাতেও কতকগুলি প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নগুলি গুরুতর এই জন্য যে, তেলঙ্গানায় কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার চার মাস পর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হল, এবং ইতিমধ্যে ‘জাস্টিস ফর রোহিত ভেমুলা’ আন্দোলনটিতে রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস নিজেদের জোরালো সমর্থন এগিয়ে দিয়েছেন, এবং এই রিপোর্ট প্রকাশের পরও কংগ্রেসের তরফে সেই সমর্থনে বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি। এখানেই ঘটনাটির বিশেষ গুরুত্ব প্রোথিত।

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, যদি সত্যিই ভুল জাতিগত পরিচয় দিয়ে থাকেন আত্মঘাতী ছাত্র, তা হলে কেন আর তাঁর নামে আন্দোলনে রাজনৈতিক সমর্থন জানানো? এখানে দু’টি কথা থেকে যায়। প্রথমত, যদি এ-যাবৎ প্রকাশিত তথ্য ঠিক হয়, তবে বলতে হয় রোহিত ভেমুলা সম্পূর্ণত ভুল পরিচয় দেননি, তাঁর পরিবারে তফসিলি পরিচয়ের স্থান আছে, প্রত্যক্ষে নয়, পরোক্ষে। কিন্তু আসল কথা— তিনি যে বৈষম্য অনুভব করেছিলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং যে নিষ্করুণ ব্যবহারের মুখোমুখি হয়ে মানসিক ভাবে দুর্বল ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিলেন— সেই বৈষম্য ও সেই নিষ্করুণতার হেতু-ব্যক্তিরা কিন্তু তাঁকে তফসিলি-গোত্রীয় জেনেই যা অন্যায় করার তা করেছিলেন। সেই অন্যায় অন্যায়ই থাকে— তাঁর সত্য পরিচয় জানা থাকুক আর না থাকুক।

দ্বিতীয় যুক্তিটি প্রথম যুক্তির সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। রোহিত ভেমুলার জন্য ন্যায়বিচারের আন্দোলন কি একা রোহিতেরই জন্য? তেলঙ্গানা বা ভারতের নাগরিক সমাজ কি জানে না কী অপরিসীম বৈষম্যের মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া জাতি-জনজাতির মানুষকে পথ হাঁটতে হয়? সংরক্ষণের মাধ্যমে তাঁরা কোনও উচ্চ পদে পৌঁছলেও কত নিষ্ঠুর বাক্য ও নির্দয় আচরণের সামনে তাঁদের সহনশীলতার পরীক্ষা দিতে হয়? এই সব আচরণ যে থানা বা আদালতে অনেক সময়ই প্রমাণ করা যায় না, সে কথাও কি সচেতন নাগরিক জানেন না? সামাজিক ন্যায়ের বিচার ব্যক্তির জন্য নয়, গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখেই। রোহিত ভেমুলা মামলাটির গতিপ্রকৃতি যা-ই হোক না কেন, তাতে রোহিত ভেমুলা আন্দোলনের গুরুত্ব এক চুলও কমে না। তফসিলি জাতি-জনজাতির প্রতি নিষ্ঠুরতা হেতু (এসসি-এসটি প্রিভেনশন অব অ্যাট্রসিটিজ় অ্যাক্ট) অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনীত হয়েছিল। ভেবে দেখা দরকার, ভেমুলাকে এসসি বলে মনে করে যে বা যাঁরা এই বৈষম্যবন্যায় যতি টানেননি, তাঁরা কি সত্যিই ‘নিষ্ঠুরতা’র দায়ে দায়ী নন? কথাটা একটু জটিল হলেও অত্যন্ত জরুরি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তা হলে এই প্রশ্নের সন্তোষজনক মীমাংসা দরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rohith Vemula Death Congress

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy