প্রতিবাদ: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন মুসলমানরা। জঙ্গিহানায় ১৫ জনের মৃত্যুর পর। বার্সেলোনা, ২১ অগস্ট, ২০১৭। ছবি: এএফপি
পর পর তিনটি জঙ্গি হামলা সংঘটিত হল ইউরোপের মাটিতে। প্রথম দুটি স্পেনে ও তৃতীয়টি ফিনল্যান্ডে। এখনও পর্যন্ত খবর অনুযায়ী সর্বমোট ১৬ জন মৃত ও প্রায় শতাধিক আহত। এখন আর জঙ্গিরা বোমা বা আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষ ব্যবহার করছে না। মানুষ মারার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে গাড়ি-ট্রাক বা ছোরাছুরির মতো ধারালো অস্ত্র। কিন্তু কেন ঘটছে অহরহ এই হত্যালীলা? গত ২/৩ বছরে প্রায় সাড়ে চারশো মানুষ নিহত হয়েছেন ইউরোপের মাটিতে জঙ্গিদের হাতে। কিন্তু এই জঙ্গিরা কারা?
সমসাময়িক ফ্রান্সের অন্যতম শক্তিশালী লেখক মিশেল উয়েলবেক ২০১৫ সালে একটি উপন্যাস লেখেন, এক কল্প-রাজনৈতিক উপাখ্যান। ‘সুমিসিয়োঁ’ অর্থাৎ ‘নতিস্বীকার’। ইসলামি মৌলবাদের কাছে ফ্রান্সের ধর্ম-নিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক পরম্পরার নতিস্বীকার। পরম্পরাগত দলগুলি প্রাথমিক পর্বে হেরে বিদায় নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মূল ও অন্তিম পর্বে, উগ্র-জাতীয়তাবাদী মারিন ল্য পেন-এর মুখোমুখি হয়েছেন কট্টর তালিবানি এক প্রতিনিধি। অবশেষে মধ্যপন্থী, মৃদু দক্ষিণ-পন্থী ও সমাজতান্ত্রিকদের সমর্থনে ফ্রান্সের তখতাসীন হবেন মৌলবাদী প্রার্থী। আস্তে আস্তে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে ফরাসি তথা আন্তর্জাতিক তালিবানরা—এই হল মোদ্দা কাহিনি।
অভিযোগ, উপন্যাসটি বকলমে উসকে দিতে চায় প্রাচ্যের ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির উলটো পিঠে থাকা প্রতীচ্যের বর্ণবিদ্বেষী উগ্র-জাতীয়তাবাদকে। কেননা, অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ‘নতিস্বীকার’-এর এই কল্পিত ভয়ের উপরই নির্ভর করে উগ্র জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব।
এর বিপ্রতীপে রাখা যায় এক প্রতি-আখ্যানকে; ‘লা এন’। ঘৃণা। মাতিও কাসোভিচ-এর ১৯৯১-র ছায়াছবি। প্যারিসের উপকণ্ঠের অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চোখে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কল্পনা আর সেই কল্পনার মর্মে নিহিত বৈষম্য-অবিচারের রক্তাক্ত ছবি। সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে ঘেটোর তরুণের একমাত্র সংযোগ-বিন্দু হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রের শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী। সমাজের সঙ্গে তার সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যম, অতএব, প্রধানত সশস্ত্র ও দমন-পীড়ন ভিত্তিক।
এ চিত্র শুধু ফ্রান্সের না। পশ্চিম ইউরোপের সব দেশেই অভিবাসী-প্রধান দুঃস্থ পাড়ায় তরুণদের জীবন একই খাতে বয়ে চলে; বেকারত্ব, তার থেকে একঘেয়েমি, তার পর চরসের নেশা। নেশার পয়সা উসুল করতে ছোটখাটো কুকর্মে হাতেখড়ি, হাজতবাস এবং ক্রমশ অপরাধ-জগতে প্রবেশ। সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও দারিদ্রের চাপে অভিবাসী তরুণ যখন পরিণত হয় বারুদের স্তূপে, তার সলতেতে আগুন ধরাতে এগিয়ে আসেন স্বঘোষিত কোনও ধর্মীয় ‘গুরু’। তাঁর সংস্পর্শে হঠাৎ এক দিন মিশুকে ছেলে বা মেয়েটা নিজের ভিতর কেমন গুটিয়ে যায়। একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যায় যেন। ধর্মীয় আচার-নিয়মে কট্টরপন্থী হয়ে ওঠে। খাদ্যাভ্যাস বদলে যায়। তার পর এক দিন কোনও এক ছুতোয় সে পা রাখে সিরিয়া বা ইরাকে। হয়তো একেবারে বেপাত্তা হয়ে যায়। তার পর, তাকে দেখা যায় ইরাকে বা সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে কালশনিকভ হাতে। আর যদি দেশে ফেরে তো মাথায় নিয়ে মারাত্মক গূঢ় কোনও অভিসন্ধি।
১৯৬৮-র যুব বিদ্রোহে, ফ্রান্সের নৈরাজ্যবাদী তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যৌনতার অবাধ প্রমোদে মুক্তি খুঁজে নিতে। এ সময়ের উগ্র ইসলামে দীক্ষিত তরুণ ঠিক যেন তার উলটো। যৌনতার অবদমনের মধ্যে সে পরিশুদ্ধির শ্লাঘা বোধ করে। এই আত্ম-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে সে শোধ তুলতে চায় তার সামাজিক বঞ্চনার। প্রত্যেক সন্ত্রাসী তার সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও অবিচারের ছবিটিকে ছুপিয়ে নেয় অস্বাভাবিক গাঢ় রঙে। যাতে তার মনে ও শরীরী ভাষায় ফুটে ওঠে এক সর্বগ্রাসী ক্রোধ।
ঘেটোর আর পাঁচটা সাধারণ দাগির ক্রোধ সাময়িক বশ মেনে যায় কুকর্মের কড়ির জোরে খানিক আরাম-আয়েস করলেই। কিন্তু জিহাদির প্রয়োজন হয় নিজেকে প্রমাণ করার। হৃত মর্যাদাবোধ ফিরে পাওয়ার, ক্ষমতায় ‘অপর’কে টেক্কা দেওয়ার। তার কল্পিত ‘নিপীড়ক’ সেই ‘অপর’, যার জীবনের মূল্যে নিজের ভিতরে পরিশুদ্ধি ঘটাতে চায় সে। হীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে চায়। যে সমাজ তাকে এত দিন বাতিল ঘোষণা করেছিল সেই সমাজকে অপবিত্র, অচ্ছুত প্রমাণ করে, তাকে সন্ত্রস্ত করে, শাস্তি দিয়ে তার আত্মার শান্তি হয় যেন।
ইসলাম মানেই কি জঙ্গিপনা? মোটেই না। শান্তিপ্রিয় ইসলাম ও জঙ্গি ইসলামের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তবে কারও কারও মতে, এই দুই ইসলামের মধ্যে যোগস্থাপনের কাজ করছে ইসলাম ধর্মের অন্তর্গত কিছু কট্টর উপধারা। গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক অবধি, অর্থনৈতিক বিকাশের স্বর্ণ যুগে ইউরোপের অভিবাসী পাড়াগুলি ছিল প্রধানত শ্রমিক অধ্যুষিত, সমাজতান্ত্রিক দলের ঘাঁটি অঞ্চল। পরবর্তী কালে অর্থনৈতিক বিকাশের ভাটা ও বিশিল্পায়নের যুগে শ্রমিক-বন্ধু সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সংকুচিত হতে হতে প্রায় শূন্যে মিলিয়ে যায়। আর সেই শূন্যতাকে ভরাট করতে আসে মৌলবাদী ধর্মীয় ভাবধারাগুলি। ঘোর পশ্চিম-বিরোধী ইসলামের এই মতবাদ ধর্মের প্রাচীন মূলে ফিরে যাওয়ার কথা বলে, খলিফাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, যার বাস্তব ফলিত প্রয়োগ ঘটেছে সিরিয়ার ইসলামি জঙ্গি রাষ্ট্রে। অর্থাৎ ধর্ম নিছক নিভৃত চর্চার বিষয় না থেকে হয়ে দাঁড়ায় এক সর্বব্যাপক রাজনৈতিক কর্মসূচি। জঙ্গি ইসলামের এই তাত্ত্বিক রূপায়ণ ও তার প্রসারের মদত আসছে প্রধানত সৌদি আরব, কাতারের মতো দেশগুলি থেকে। অথচ তার প্রয়োগ-ভূমি সিরিয়ার প্রতি পশ্চিমি জোটশক্তি যতটাই নির্দয়, আঁতুড়-ঘর সৌদি আরবের প্রতি ততটাই প্রশ্রয়শীল। ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো দেশে জঙ্গি ইসলামের এত বাড়বাড়ন্তর পিছনে অনেকেই দায়ী করছেন পশ্চিমের এই একচক্ষু কূটনীতিকে।
সন্ত্রাসী জিহাদির কিন্তু একটাই ধর্ম— বদলার ধর্ম। তথাকথিত জিহাদি ধর্মগুরুরা তাদের সমর্থকদের ডাক দেন ‘ধর্মযুদ্ধে’। পৃথিবীর সব যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে মুসলমান আক্রান্ত হচ্ছেন, সেখানে ‘সাচ্চা’ মুসলমানকে শামিল হওয়ার ফতোয়া জারি করেন। পোড়-খাওয়া এই সব জঙ্গি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। যে দেশে তারা ডালপালা বিস্তার করেছে সেই দেশের অন্দরে, বা তার বাইরে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে বা প্রথম বিশ্বের কোনও জেলখানায়। আল-কায়দা বা অন্য কোনও ইসলামি জঙ্গি দলের হয়ে এরা নিরন্তর সক্রিয়। এদের মধ্যবর্তিতায় জঙ্গলের নিয়মে লালিত ঘেটোর তরুণরা পরিণত হয় মানব-বোমায়। তার পর, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’র মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর।
শার্লি এবদো-র দফতরে জঙ্গিহানার পর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এ বার কড়া দাওয়াই দেবে ফ্রান্স’। আর স্পেনের প্রধানও বললেন, কোর্ট যাতে অপরাধীদের কঠিন সাজা দেয় তা নিশ্চিত করা হবে। ঠিক। তবে শুধু যুদ্ধ ঘোষণা করে বা জেলে পাঠিয়ে জঙ্গিদের নিরস্ত করা যাবে তো?
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, কলকাতা-য় শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy