সুকুমার রায়।
সুকুমার রায়ের মৃত্যুর শতবর্ষ? মানে যিনি ছোটদের জন্য পাগলা দাশু, হ য ব র ল, আবোল তাবোল এ সব লিখেছিলেন! উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছেলে, সত্যজিৎ রায়ের বাবা, ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কালাজ্বরে মৃত্যু। ইংরেজ কবি জন কিটস অবশ্য ছাব্বিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। শেলি-ও মারা গিয়েছেন মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে। ফরাসি কবি আপোলিনিয়ের যখন স্প্যানিশ ফ্লু-তে ভুগে মারা গেলেন, বয়স মাত্র আটাশ। বিয়ের পরের বছরই জলে ডুবে আত্মহত্যা করার সময় সিলভিয়া প্লাথ মাত্র ত্রিশ বছরের তরুণী।
এত অকালপ্রয়াত কবিদের কথা কেন? সমাজ ও স্বভাষার সাহিত্য তাঁদের আজও বিস্মৃতিতে ঠেলে দেয়নি। শেলি, কিটসরা আজও রোম্যান্টিকতার প্রতিভূ, আপোলিনিয়ের গঠনবাদী, সারিয়ালিস্ট কবিতার, সিলভিয়ার কবিতায় আসত আত্মজৈবনিক স্মৃতি। কিন্তু সুকুমার রায়? যে সমাজে নেতারা হাসতে হাসতে বিরোধী মতকে ধ্বস্ত করতে পারেন না, উল্টে প্রত্যহ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে একে অপরকে গালিগালাজ করেন, এ ওকে চোর আর ও তাকে সাম্প্রদায়িক বলেই রাজনৈতিক কর্তব্য শেষ করেন, এ কালো ঝোলা-পরা হুতোম পেঁচার মতো নতুন ন্যায়সংহিতার কথা বলে, ও ইন্ডিয়া নামে চার দিক ঝালাপালা করে, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপমৃত্যু থেকে চোখ সরিয়ে দু’পক্ষই চিৎকৃত তরজায় মাতে, সেখানে সুকুমার রায় অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। ভানু-জহর, রবি ঘোষ, উৎপল দত্তের বাংলায় ক’টা হাসির ছবি তৈরি হয়? সর্বত্র গালাগালি আর ‘রিমেড’ গোয়েন্দার বন্যা! এই সমাজ বাঁচিয়ে রাখবে সুকুমার-স্মৃতি?
দিন কয়েক আগের সফল চন্দ্রাভিযান মনে পড়ে যাচ্ছে। কেউ যজ্ঞে, কেউ বা জাতীয়তাবাদে ডগমগ। কেউ আবার বিজ্ঞানীদের হাতে কেন গ্রহরত্নের আংটি, তা নিয়ে মিম তৈরিতে ব্যস্ত। সফল চন্দ্রাভিযান মানে এ সব কিচ্ছু নয়। ১৯২০ সালেই সন্দেশ পত্রিকায় ‘চাঁদমারি’ প্রবন্ধে সুকুমার লিখছেন, “প্রথম ধাক্কাতেই হাউই অনেক দূর পর্যন্ত যায়, তারপর যেই তেজ কমে আসতে থাকে, অমনি আবার দ্বিতীয় ধাক্কা এসে লাগে। আরও অনেকখানি বড় করে যদি চাঁদমারি হাউই বানানো যায়, আর তার মধ্যে দু চার জন মানুষ থাকবার মতো ঘরের ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে মানুষও চাঁদে বেড়াতে যেতে পারবে না কেন?” বাংলা ভাষায় অনেকেই আজ বিজ্ঞানচর্চা করেন, কিন্তু আনাড়ি পাঠককে তার দেখাশোনার চার পাশের উদাহরণ দিয়ে সহজ করে বোঝানো? সুকুমার এক প্রবন্ধে আলোর গতিবেগের কথা বলছেন, “ট্রেনটা যতক্ষণে এক ইঞ্চি যাবে, আলো ততক্ষণে কলকাতা থেকে ছুটে গিয়ে মধুপুরে হাজির হবে।” সহজ ভাষায় ছোটদের বিজ্ঞান বোঝানোর লোক আর নেই। সাধে রবীন্দ্রনাথ সুকুমার সম্পর্কে লিখেছিলেন, “তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তার বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন।” বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি না থাকার জন্যই তো ‘এপাং ওপাং ঝপাং/ সুর ধরেছে পটাং’ নামের অর্থহীন কথাও আজ সম্মাননীয় কবিতা।
ক্ষমতার সম্মার্জনী যে কত কিছু উড়িয়ে দিল! “ছেলেবেলায় আমরা শুনিয়াছিলাম, মানুষের পূর্বপুরুষ বানর ছিল। ইহাও শুনিয়াছিলাম যে ডারুইন নামে কে এক পন্ডিত নাকি এ কথা বলিয়াছেন। বাস্তবিক ডারুইন এমন কথা কোনদিন বলেন নাই। আসল কথা এই যে অতি প্রাচীনকালে বানর ও মানুষের পূর্বপুরুষ একই ছিল। সেই এক পূর্বপুরুষ হইতে বানর ও মানুষ, এ দুই আসিয়াছে, কিন্তু সে যে কত দিনের কথা তাহা কেহ জানে না।” একশো বছরেরও আগে লিখেছিলেন সুকুমার! অথচ কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় শাসক পাঠ্যসূচি থেকে ডারউইন তুলে দেওয়ার পরও বাঙালির প্রতিক্রিয়া কী? ‘ওরা কত ধর্মান্ধ, আমরা কত উদার’ চিৎকার। ডারউইনের অভিব্যক্তি তত্ত্ব যে একেবারে অন্য, বানর থেকে মানুষ হয়নি, এক বারও বললাম না। সুকুমার রায় সহজ সূত্রটা দিয়ে যাওয়ার পরও না!
শুধু এই? যে দেশ যশোর রোড, সুন্দরবন, ছত্তীসগঢ় থেকে মধ্যপ্রদেশ, সর্বত্র উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলে, সেখানে সুকুমার রায় বহু দিন মৃত। “প্রতি বছর এক কোটি মণ কাঠ মানুষ খরচ করে এবং তার জন্য এত অসংখ্য গাছ কাটতে হয় যে অনেকে আশঙ্কা করেন, হয়ত বেহিসাবী যথেচ্ছ গাছ কাটতে কাটতে পৃথিবীতে কাঠের দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হবে,” প্রবন্ধে লিখছেন সুকুমার। মৃত্যুশতবার্ষিকী পালন-করা হুজুগে বাঙালি নয়, বরং দীপেশ চক্রবর্তী বা অমিতাভ ঘোষের পরিবেশচেতনায় আজ তাঁর উত্তরাধিকার।
বস্তুত হিন্দি-ইংরেজি মিশ্র ভাষায় অভ্যস্ত বাঙালি আজ যথাযথ বাংলা পরিভাষা আবিষ্কারের কোনও চেষ্টা করে না। অথচ সুকুমার সাবমেরিনকে লিখছেন ডুবুরি জাহাজ, পেরিস্কোপকে দিকবীক্ষণ, সিসমোগ্রাফকে কম্পনলিপি যন্ত্র, টিউব রেলকে সুড়ঙ্গ রেল। পরিভাষা তৈরিতেও সুকুমার রায় এই বঙ্গে বিস্মৃত, বাংলাদেশ বরং এই বিষয়ে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। সিদ্ধার্থ ঘোষের হিসাব, সন্দেশ পত্রিকায় স্বনাম ও বেনামে ১৬টি জীবনী, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কারিগরি আবিষ্কার, শিল্প উদ্যোগ, ইতিহাস, সভ্যতা ইত্যাদি নিয়ে মোট ১০৫টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন সুকুমার। ১৬টা জীবনীই ডারউইন, জোয়ান অব আর্ক, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল, লিভিংস্টোনদের নিয়ে। এখন হলে লোকে হিসাব চাইত, বাঙালি কোথায়? সবাই ক্ষুদ্রতার সাধনায় ব্যস্ত। কেউ বলেন, আমরা বাঙালিরাই সেরা। আমাদের রামমোহন, বিবেকানন্দ আছে। কেউ আবার নিজেকেই বিশ্বগুরু বলে নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছেন। কেউ ডিনারে রাষ্ট্রনায়কদের নিরামিষ কাঁঠালের আমসত্ত্ব খাওয়াচ্ছেন, কেউ রাস্তায় বসা কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীর চোখের জলকে পাত্তা না দিয়ে মন্ত্রী-বিধায়কদের মাইনে বাড়াচ্ছেন। বাঙালির কাছে আজ একুশে আইন স্রেফ জীবনমুখী গানে গণেশ পাইনের সঙ্গে অন্ত্যমিল দেওয়ার ফিকির।
গাড়ুর নাম পরমকল্যাণবরেষু আর ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব নিয়ে হ য ব র ল-য় যখন তিনি হাস্যমুখর, তখন কি জানতেন ভবিষ্যতে বাঙালি বাড়ির নাম রাখবে নবান্ন আর রাস্তার নাম ধরণী? মায়, বাংলার বাইরে ফৈজ়াবাদ স্টেশন নাম বদলে হয়ে যাবে অযোধ্যা, আর ইলাহাবাদ হয়ে উঠবে প্রয়াগরাজ? অকিঞ্চিৎকর নাম বদলই হয়ে উঠবে ক্ষমতার কার্যক্রম! দ্রিঘাংচু বা কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো দাঁড়কাকের উত্তরসূরিকে অবশ্য পাওয়া গিয়েছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের কাঙাল মালসাট উপন্যাসের দণ্ডবায়স। আজকের নেকুপুষু সমাজে সুকুমার তাই বিপজ্জনক। “শাস্ত্রে ত্যাগ বলিতে কি কি ছাড়িতে উপদেশ দেয় তাহা বুঝি আর নাই বুঝি আমরা ঐ ত্যাগ শব্দটার সঙ্গে ছাড়ার সংস্কারটুকুকে ধরিয়া রাখি। অমুক সংসার ছাড়িয়া পলাইয়াছেন, তিনি ত্যাগী। অমুক এত টাকা দান করিয়াছেন, তিনিও ত্যাগী। কর্মফলাসক্তি বিন্দুমাত্র কমিল না, দেহাত্মবুদ্ধির জড় সংস্কার ঘুচিল না, প্রভুত্বের অভিমান ও অহঙ্কার গেল না, অথচ শাস্ত্রবাক্যেরই দোহাই দিয়া ত্যাগের মাহাত্ম্য প্রমাণিত হইল,” ভাষার অত্যাচার প্রবন্ধে লিখছেন তিনি।
শব্দে যে কত অর্থসংস্কার! “জ্যান্ত জ্যান্ত শব্দ, যাদের চলৎশক্তি চাপা রয়েছে, ধরে ধরে মটমট করে তাদের বিষদাঁত ভাঙতে হবে,” শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম নাটকে বলেন সুকুমার। এ সব লেখার কয়েক বছর আগে ১৯১৩ সালে মারা গিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর। বাঙালি এর পর ফুকো, দেরিদা অনেক কিছু শিখেছে, সুকুমারকে শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে নির্বাসন দিয়েছে। দুপুরের মেট্রোয় স্কুলের পোশাকে অনেক দাশু, জগবন্ধুকে দেখি। তারা ক্লান্ত, কোনও ক্রমে সিটে বসলেই অভিভাবিকা চাপা গর্জন করেন, “এটাও পারিসনি! রাম পারল কী ভাবে!” দাশুরা নয়, এই সমাজে তাদের মা-বাবারা কি সত্যিই পাগল? অমর্ত্য সেন বরং যখন সখেদে এ দেশকে ‘কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ়’ বলেন, তিনি হয়ে ওঠেন সুকুমারের উত্তরসূরি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোঁসাইবাগানের ভূত উপন্যাসের করালী স্যরের মধ্যেও আছে নম্বরদৌড়ের বিরুদ্ধে এই অন্তর্ঘাত। বুরুনদের ক্লাসে সবাইকে অঙ্কে তেরো দেন তিনি।
এই অন্তর্ঘাতের কথা কিন্তু কেউ বলে না। তিনি কি শুধু লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকে রাম, সুগ্রীব, জাম্ববান নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন? ঝালাপালা নাটকে কেদার পণ্ডিতমশাইকে বলে, “অমানিশার গভীর তমসাজাল ভেদ করিয়া... বিহঙ্গের কলকল্লোল, শিশিরসিক্ত বায়ুর হিল্লোলে দশ দিগন্ত মুখরিত হইয়া, আহা, স্বভাবের সেই শোভা ভারি চমৎকার হয়েছে। হে মানবসকল, ঐ শুন বাছুরগুলি ল্যাজ তুলিয়া হাম্বা হাম্বা রবে ছুটিতেছে, তোমরা উত্তিষ্ঠত জাগ্রত।” বঙ্কিম থেকে বিবেকানন্দ সকলের উদ্দেশে অন্তরটিপুনি।
এখানেই সুকুমার-ঐতিহ্য। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গোপাল রাখাল দ্বন্দ্বসমাস বইয়ে দেখিয়েছিলেন, দাশু নিছক মিচকে নয়। স্কুল নামক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাকে, ভাল ছেলে তৈরির ঔপনিবেশিক নিক্তিকে অস্বীকার করে সে। আজ বরং চেরিং ক্রস স্টেশনের ৯ ৩/৪ প্ল্যাটফর্ম বেয়ে যারা হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস ধরে, জে কে রোলিং-এর সেই ছেলেপুলেরাই হয়তো দাশুর উত্তরাধিকারী। সুকুমার রায় কোনও বিশেষ ভাষায়, ‘স্কুল স্টোরি’ নামক বিশেষ ঘরানায় সীমাবদ্ধ নন। “সবটাকেই তিনি করে নেন আপন, আর সেইখানে, সব অসম্ভবের মধ্যে তিনি পেয়ে যান তাঁর ছন্দ,” সুকুমার রায়ের কবিতা সম্বন্ধে একদা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সব কিছুকে যারা আপন করে নিতে পারে না, নেড়া বেলতলায় গেলে বা সুকুমার রায়ের শততম প্রয়াণবর্ষে ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ সেই সব বাঙালির কী আসে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy