এত দিন বলা হইতেছিল, এ দেশে গণতন্ত্রের দশা করুণ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস প্রমাণ, এ দেশে প্রজাতন্ত্র বলিয়া আর কিছু নাই। ভারত নামক দেশটির প্রথম ও সত্য পরিচয় এখন, গুন্ডাতন্ত্র, যাহা সমস্ত রকম আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সরকারকে ধন্যবাদ যে সত্তর বৎসর বয়সি দেশটিকে তাঁহারা এখানে পৌঁছাইয়া দিতে পারিয়াছেন। একটি চলচ্চিত্রের মুক্তি উপলক্ষে গোটা উত্তর-ভারত (নানা অর্থেই যাহা দেশের ‘হৃদয়পুর’) জুড়িয়া করণী সেনা নামক সংগঠনের অবাধ তাণ্ডব চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয় যে, এই তাণ্ডবের দায় প্রথমত ও প্রধানত দেশের শাসকদের। কেন্দ্রের ও রাজ্যের শাসকরা তাণ্ডব থামাইতে চাহেন না, চাহেন নাই। হয় ইহাতে তাঁহাদের সম্পূর্ণ সায় আছে, নতুবা তাঁহারা এই তাণ্ডবে হস্তক্ষেপ করিতে ভয় পান। কয়েক মাস আগে অবধিও যে করণী সেনার নাম স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় শুনিয়াছেন, তেমন একটি দল যে এত বড় দেশের এতগুলি রাজ্য জুড়িয়া এই কাণ্ড করিতে পারিল, তাহাই বলিয়া দেয় শাসকের ভূমিকা। অথচ ‘পদ্মাবত’ মুক্তির আগেই ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়াছিল যে রাজ্য প্রশাসনগুলিকে যে কোনও ভাবে এই নৈরাজ্যের মোকাবিলা করিতে হইবে। সরকারি তরফে কত কম প্রস্তুতি ও ইচ্ছা থাকিলে এমনকী পথ-চলতি স্কুলবাসের উপরও হামলা চলে, বাসভর্তি আর্তনাদরত শিশু সিটের নীচে লুকাইয়া আত্মরক্ষায় বাধ্য হয়, বুঝিতে অসুবিধা নাই। রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ জুড়িয়া হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ংকর হিংসার ছবি আটষট্টিতম প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশকে একটি গুরুতর প্রতীক উপহার দিল। দেশের সমাজ ও রাজনীতি কোন অতলে নামিয়াছে, তাহার প্রতীক।
প্রতীকটি গুরুতর, কেননা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হাল বিষয়ে ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাইয়া যায়। আটষট্টি বৎসর আগে যখন ভারত স্বেচ্ছায় প্রজাতন্ত্র হইয়াছিল, তখন নিশ্চয় প্রজাতন্ত্রের অর্থ বুঝিয়াই শপথ লইয়াছিল। ভাবিয়াছিল যে, এ দেশে মানুষ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের উদ্ধত তর্জনীতে চলিবে না, সমস্ত নাগরিক এই রাষ্ট্রের অংশ হইবেন, রাষ্ট্রের দায় ও দায়িত্ব বহন করিবেন। প্রজাতন্ত্র যখন এ-ভাবে স্বেচ্ছায় সকল প্রজাকে রাষ্ট্রচালনার অংশী করে, তাহা গণতন্ত্রের অনেক উচ্চ এক আদর্শে পৌঁছাইয়া দেয়। সেই আদর্শে সংখ্যার জোরে গা-জোয়ারি কিংবা তাণ্ডবের কোনও স্থান নাই। সমস্ত নাগরিকের রক্ষাকল্পে সেখানে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নির্ভর প্রশাসন থাকে, সংখ্যার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধির স্বেচ্ছাচারিতা চালানো হয় না, বিচারবিভাগের নির্দেশ শাসনবিভাগ ফুৎকারে। উড়াইয়া দিতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রিপাবলিক হিসাবে গড়িতে গিয়া গণতন্ত্র নামক নীতি লইয়া অন্যতম সংবিধান-পুরুষ আলেকজান্ডার হ্যামিলটন সাধে দুশ্চিন্তায় পড়েন নাই। প্রজাতন্ত্রকে নিরাপদে রক্ষা করিবার জন্য গণতন্ত্র কিছু কম থাকিলেই উত্তম কি না, এই ছিল তাঁহার ভাবনা।
কেবল করণী সেনা নহে। রাজস্থানের যে বিক্ষুব্ধ নারীবাহিনী হুমকি দিয়াছেন যে ‘পদ্মাবত’ মুক্তি পাইলেই সকলে মিলিয়া জহরব্রতে ঝাঁপাইয়া পড়িবেন, তাঁহারাই প্রমাণ, এখন ভারতের সর্বত্র ‘ভাবাবেগ’-এর নামে কী বিপুল অসহিষ্ণুতা। এইটুকু মানিতে কেহ রাজি নহেন যে, সংখ্যায় যতই অধিক হউন, তাঁহারা কেবল দেশের একটি অংশমাত্র, তাঁহাদের পাশাপাশি আরও অনেক ভিন্ন মতের থাকিবার ও বাঁচিবার অধিকার আছে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকার নিজেরাই অসহিষ্ণু হইয়া সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধের পক্ষপাতী। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের মূল কথা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পারস্পরিক সহনের শিক্ষা লইতে নাগরিক সমাজ ও শাসক সমাজ উভয়েই চূড়ান্ত অনিচ্ছুক। তবে আর প্রজাতন্ত্র দিবসের নামে এতশত ঘনঘটাতেই বা কী লাভ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy