বারুদ মাখা গায়েই কাজে ব্যস্ত। চম্পাহাটিতে। নিজস্ব চিত্র
পশ্চিমবঙ্গে শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন যথাবিধি রহিয়াছে। নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং সমাজকল্যাণ দফতর রহিয়াছে, জেলায় প্রশাসন এবং থানায় পুলিশ রহিয়াছে। তবু বাজি বানাইয়া চলিয়াছে শিশুরা। শিল্পটি বিপজ্জনক, কারখানাগুলিও অবৈধ। সুরক্ষা ব্যবস্থা বলিতে কর্মচারীদের প্রতি মালিকের নির্দেশ: দূরে গিয়া বিড়ি খাইতে হইবে। ছোট ছোট ঘরে আতসবাজি ও তাহার মালমশলা, সকলই মজুত করা থাকে। সংবাদে প্রকাশ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলার নানা এলাকায় নাইট্রোগ্লিসারিনের মতো ভয়ানক বিস্ফোরকও অবাধে ব্যবহৃত হইতেছে। বিস্ফোরণ না ঘটিলেই শিশুরা নিরাপদ, এমন নহে— সারা গায়ে বারুদ মাখিয়া তাহারা কাজ করে সারাদিন, ফলে বিবিধ চর্মরোগ দেখা দেয়। বিপজ্জনক রাসায়নিক লইয়া দীর্ঘ ক্ষণ কাজের ফলে আরও কী কী বিপত্তি ঘটিতেছে, দেখিবে কে? এই রাজ্যেই ২০১৫ সালে মেদিনীপুরের পিংলায় এক অবৈধ বাজি কারখানায় কাজ করিতে গিয়া বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়াছিল বারো জনের, তাহাদের আট-দশ জন শিশু। কলিকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করিয়াছিলেন, জেলা প্রশাসনের চোখের সামনে কী করিয়া ওই শিশুরা বাজি কারখানায় কাজ করিতেছিল?
পিংলার ভয়াবহ ঘটনার পরে যথারীতি ক্ষোভ ও সহানুভূতির নাটক অভিনীত হইয়াছিল। শিশু কমিশনের সদস্যরা সুতি-১ ব্লকে ছুটিয়াছিলেন, শিশুশ্রম বন্ধ করিতে নানা পরিকল্পনা ঘোষিত হইয়াছিল। অতঃপর যথাপূর্বম্। পুনরায় ২০১৭ সালে কলিকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে চকলেট বোমা নির্মাণরত শিশুদের বিষয়ে সংবাদ দেখিয়া তদন্তের নির্দেশ দিয়াছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তদন্তের ফল অজ্ঞাত। তবে বিস্ফোরণে শিশুমৃত্যু থামে নাই। গত কয়েক বৎসরে উত্তর চব্বিশ পরগনার নীলগঞ্জের নারায়ণতলা, হাওড়া আমডাঙার ভালুকা গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর এগরা-১ ব্লকের কাসারদিহা, ওই জেলারই ময়না উত্তরপুর গ্রাম-সহ নানা স্থানে বাজি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণে শিশুশ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটিয়াছে। এই বৎসর দুর্গাপূজার পূর্বে বারুইপুরে এক কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হইয়াছে দুই নাবালকের। ফের এই বৎসর কালীপূজার পূর্বে সর্বাঙ্গে বারুদ মাখিয়া কর্মরত চম্পাহাটির বালকের ছবি প্রকাশিত হইল।
প্রশাসন ব্যর্থ, পুলিশ বিবেকহীন, কেবল এই অভিযোগ তুলিয়া থামিলে চলিবে না। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার ব্যর্থতার দায় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কের। বিশেষত ভাবিতে হইবে ‘নৈতিক ক্রেতা’ হইবার দায়টি লইয়া। ক্রেতা কেবল পণ্যের মান এবং মূল্য বিচার করিবেন কেন? পণ্য উৎপাদনের পদ্ধতিও দেখিবেন। অনৈতিক উপায়ে পণ্য নির্মাণ বা বিপণন হইয়া থাকিলে তাহা বর্জন করাও ক্রেতার দায়। বহু দেশের ক্রেতা শিশুশ্রমিক বর্জনের অঙ্গীকার দাবি করেন উৎপাদকের নিকট। পশ্চিমবঙ্গে কেন সেই দাবি উঠিবে না? শিশুদের অল্প মজুরিতে দীর্ঘ ক্ষণ কাজ করানো সম্ভব, কার্যত বন্দি করিয়া রাখা যায়, সেই জন্যই এই বিপজ্জনক শিল্পে শিশুশ্রমিকের এত চাহিদা। যে উৎসবের জন্য সুলভে বাজির জোগান দিতে প্রতি বৎসর শিশুদের হাত উড়িয়া যায়, দেহ ছিন্নভিন্ন হয়, তাহা কেমন উৎসব? শিশুর জীবনের মূল্যে প্রস্তুত আতসবাজি সমাজের অন্ধকারকেই গাঢ় করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy