Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Newsletter

মুখটা যে পুড়েছে, তা কিন্তু চিন লুকোতে পারছে না

যুদ্ধ বা সামরিক সঙ্ঘাত কোনও পরিস্থিতিতেই কাম্য নয়। চিন এবং ভারতের মতো বৃহৎ শক্তি তথা পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীদের মধ্যে তো আরওই কাম্য নয়।

ডোকলামে ভারত ও চিনের সেনাবাহিনী। ফাইল চিত্র।

ডোকলামে ভারত ও চিনের সেনাবাহিনী। ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ০৫:৩৬
Share: Save:

আস্ফালনে কী লাভ হল? সম্রাটের উষ্ণীস থেকে হীরকখণ্ড খসিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল কেউ, এমন তো নয়। মাত্র কয়েকশো বর্গকিলোমিটারের এক ক্ষুদ্র মালভূমি অঞ্চল ডোকলাম। বিশাল চিনের আকারের কথা মাথায় রাখলে বেজিঙের কাছে নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর যে ভূমিভাগ, সেখানে একতরফা আধিপত্য কায়েম করা কি এতই জরুরি ছিল? শেষ পর্যন্ত আধিপত্য কায়েমে ব্যর্থ হয়েই যে ফিরতে হল, তার কী হবে? প্রবল প্রতাপ যে বড়সড় ধাক্কা খেল, তারই বা কী হবে?

যুদ্ধ বা সামরিক সঙ্ঘাত কোনও পরিস্থিতিতেই কাম্য নয়। চিন এবং ভারতের মতো বৃহৎ শক্তি তথা পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীদের মধ্যে তো আরওই কাম্য নয়। যুদ্ধ না করেই যে আপাতত অশান্তির মেঘ সরল ডোকলামের আকাশ থেকে, ভুটানের পক্ষে তো বটেই, ভারত-চিনের পক্ষেও তা অত্যন্ত মঙ্গলজনক। যুদ্ধ হলে কী ক্ষয়ক্ষতি হয়, জাতীয় অগ্রগতি কতটা মার খায়, যুদ্ধের ক্ষত কতখানি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যায়, এ সবই বহুল চর্চিত বিষয় এবং কম-বেশি সকলের জানা। তাই ডোকলামকে কেন্দ্র করে ভারত ও চিনের মধ্যে যুদ্ধ না হওয়া এবং কূটনৈতিক পথে সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়া যে গোটা পৃথিবীর পক্ষেই মঙ্গলজনক হল, তা নিয়ে কোনও যৌক্তিক মননের সংশয় থাকবে না নিশ্চয়। সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে অতএব সাধুবাদই জানাতে হচ্ছে। দুই বৃহৎ শক্তি নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা ‌যে মাথায় রাখতে পেরেছে, তারও প্রশংসাই করতে হচ্ছে। কিন্তু, ডোকলাম সঙ্কট যদি একটি মুদ্রা হয়, তা হলে সে মুদ্রার দুই পিঠ আজ দু’রকম। মুদ্রার এক পিঠে চিত্রিত হয়েছে ভারতের বিরাট সাফল্য। অন্য পিঠে ফুটে উঠেছে চিনের বড়সড় ব্যর্থতা।

ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক জানাল, ডোকলাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে দু’দেশই সহমত হয়েছে, সেনা ফেরানো শুরুও হয়ে গিয়েছে। চিনা বিদেশ মন্ত্রক এক পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানাল, ভারত নিজেদের বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু চিন ডোকলামে টহলদারি চালাবে। চিনা বিবৃতিতে ধোঁয়াশা স্পষ্ট।

প্রথমত, চিন ডোকলাম থেকে সেনা সরায়নি, ভারতই একতরফা পিছু হঠেছে— এমন একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে চিনা বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে। কিন্তু আভাসেই সীমাবদ্ধ চিনা আস্ফালন, ভারত একতরফা পিছু হঠেছে, এমন কথা আর সরাসরি বলতে পারেনি চিন।

দ্বিতীয়ত, ভুটান এবং চিনের সীমান্তে অবস্থিত ডোকলাম। সেখানে স্থায়ী ভাবে থাকার কথাই নয় ভারতীয় বাহিনীর। সঙ্কট কাটলে ভারতীয় বাহিনীর ফিরে আসাই স্বাভাবিক। আর সীমান্তে বছরভর চিনা এবং ভুটানি বাহিনীর টহলদারি চলাও স্বাভাবিক। অর্থাৎ চিনা বিদেশ মন্ত্রক নতুন কিছু বলল না।

তৃতীয়ত, ডোকলাম সীমান্তে চিনা সেনার টহলদারি নিয়ে ভারতের কখনওই কোনও আপত্তি ছিল না। ঘনিষ্ঠ মিত্র ভুটান যে অঞ্চলকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে মনে করে, সেখানে ঢুকে চিনের একতরফা আগ্রাসন এবং রাস্তা তৈরির চেষ্টাতেই ভারতের আপত্তি ছিল। রাস্তা তৈরি আটকাতেই ভারত ডোকলামে বাহিনী পাঠিয়েছিল। চিন রাস্তা তৈরির কাজ বন্ধ করে ডোকলামে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে রাজি হলেই ভারত বাহিনী ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছিল। ভারতের সেই অবস্থানকে কি টলানো গিয়েছে? রাস্তা তৈরির কাজ কি চলছে? চিনা বিদেশ মন্ত্রক এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্যই করল না। টহলদারি চলবে বলে চিন জানাল। কিন্তু রাস্তা তৈরিও চলবে, এমন কথা চিন আর বলতে পারল না।

গোটা ঘটনা পরম্পরায় কিন্তু ভারতের বিরাট জয় দৃশ্যমান। প্রথমত, চিন বহু দিন ধরেই নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা মহাশক্তিধর হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট। সমীহ আদায় করতে অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশের প্রতিই চিনা আচরণ আস্ফালনমূলক। আস্ফালনের সুযোগ হাতে রাখতেই অনেক জায়গায় চিন ইচ্ছাকৃত জিইয়ে রেখেছে সীমান্ত সমস্যা। ডোকলামে এসে সেই কৌশল প্রবল ধাক্কা খেল। ভারতের সঙ্গে চিনকে যে সমঝোতায় আসতে হল, শত হুঁশিয়ারিতেও যে ভারতকে পিছু হঠানো গেল না, এ সত্য চিনের সামরিক গরিমার পক্ষে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।

দ্বিতীয়ত, ভারত নিজেকে চিনের চেয়ে বড় শক্তি বলে কখনওই দাবি করে না। কিন্তু যে কোনও আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষা করতে যে ভারত সক্ষম, সে কথা ভারত জোর দিয়েই বলে। বেজিঙের তীব্র রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টানা ৭০ দিন চিন-ভুটান সীমান্তে যে ভাবে বাহিনী মোতায়েন রাখল নয়াদিল্লি, তাতে ভারতের সেই সামরিক সক্ষমতার প্রমাণ যে হাতেকলমে মিলল, সে নিয়ে সংশয় কমই।

তৃতীয়ত, ভারত বুঝিয়ে দিল শুধু নিজের স্বার্থরক্ষা নয়, মিত্র দেশগুলির স্বার্থরক্ষাও ভারতের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ঘনিষ্ঠ মিত্রের সার্বভৌমত্ব যখন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তখন কোনও মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও যে ভারত দ্বিধা করে না, ডোকলামে বাহিনী পাঠিয়ে ভারত সে কথাও খানিকটা প্রমাণ করল।

চতুর্থত, ডোকলাম সঙ্কটে আপাতত যে ভঙ্গিতে রণে ভঙ্গ দিল চিন, তাতে পাকিস্তান-সহ চিনের বেশ কিছু মিত্র দেশ বেশ হতাশ হল। আমেরিকার বিকল্প হিসাবে চিন নিজেকে তুলে ধরতে আদৌ প্রস্তুত কি না, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়ে গেল। উল্টো দিকে ভারতের সক্ষমতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের সমীহ আগের চেয়েও বাড়ল।

পরিশেষে আবার সেই প্রশ্ন? অতিরিক্ত আস্ফালনে কি আদৌ কোনও লাভ হল? নাকি ক্ষতিই হয়ে গেল বেশ খানিকটা? পরাজয় যে হয়েছে, সে কথা স্বীকার করা চিনের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবটাকেও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE