Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিপদের মোকাবিলায় অস্ত্র একটাই, তার নাম সংযম

আমি সোশ্যাল মিডিয়া এবং নেটিজেন হিসেবে আমাদের ভূমিকার কথা বলছি। একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে বসিরহাটে যা ঘটে গেল, তা থেকে যদি শিক্ষা না নিই, ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০০:১৮
Share: Save:

আমাদের বোধ হয় ক্রমাগত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বলতে, এ দেশের এ রাজ্যের তথাকথিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সমাজের কথা বলছি। এই মুহূর্তে যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি, তাতে আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন, আশঙ্কিত, ভীত। ক্রুদ্ধও। কিন্তু তার চেয়েও দুশ্চিন্তার কথা হল, বর্তমান সময়ের বিশেষত্বটা আমরা এখনও ভাল করে বুঝে উঠিনি। ফলে তার মোকাবিলার পথও তৈরি করতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, মোকাবিলা তো অনেক দূরের ব্যাপার, আমরা নিজেরাই জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বা উদাসীনতায় এমন অনেক কাজই করে চলেছি, যাতে জটিলতা এবং বিপদের সম্ভাবনা দুই-ই হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে।

আমি সোশ্যাল মিডিয়া এবং নেটিজেন হিসেবে আমাদের ভূমিকার কথা বলছি। একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে বসিরহাটে যা ঘটে গেল, তা থেকে যদি শিক্ষা না নিই, ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না। এ দেশ, এ রাজ্য অনেক অস্থিরতা, অনেক অশান্তি দেখেছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ সে সবের থেকে মৌলিক ভাবে আলাদা। যে কোনও মত-মন্তব্য-বিজ্ঞপ্তি-বিবৃতি-অডিয়ো-ভিডিয়ো ক্লিপ-ছবি-মিম বিকৃত এবং অবিকৃত আকারে তুরন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে চলে যাচ্ছে এবং কাদের হাতে চলে যাচ্ছে তা আপনি জানতেও পারছেন না— এই বাস্তবতার মুখোমুখি আগে আমরা হইনি। ফেসবুক পোস্ট তা-ও সবার চোখের সামনে আছে। হোয়াটসঅ্যাপ বা ওই জাতীয় মাধ্যমে ঘৃণা ও বিদ্বেষ কতটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তার তো খবরই নেই!

বাদুড়িয়ার ঘটনার উৎস আপাতভাবে একটি অতীব নোংরা ফেসবুক পোস্ট হতে পারে। কিন্তু অশান্তির জমি প্রস্তুত না থাকলে ঘটনা এই আকার নিত না। সেই জমি কত দিন ধরে, কী ভাবে তৈরি হল, তা পৃথক আলোচনার বিষয়। সেখানে জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক চেহারা এবং পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির নিজস্ব হিসেবনিকেশ স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ দাবি করে। তবে বেশ কিছু দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে খুব সচেতন ভাবে আগ্নেয়গিরি নির্মাণের কাজ চলছে, সেটা এখনই নির্দ্বিধায় বলা যায়। যে তরুণের পোস্ট থেকে এত হাঙ্গামা, সেটি একটি মিম। অনুমান করা হয়তো অসংগত হবে না, সেটি তার নিজের বানানো নয়। কে বানাল? কারা ছড়াল? চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ারযোগ্য উপাদান তৈরি এবং প্রচারের কাজে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী আদাজল খেয়ে লেগেছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে একটা রঙই আছে, সেটা ধরে নেওয়াও ভুল। একাধিক উইং এখানে সক্রিয়। সেই সঙ্গে আছে যার যার নিজস্ব ট্রোল বাহিনী। তারা তাদের ‘শত্রু’কে চিহ্নিত করে হেনস্তা করছে। অথবা, শত্রুর দেওয়ালে বা পোস্টের নীচে নিজেদের মত প্রচার করে আসছে, নিজেদের বাছাই লিংক সাঁটিয়ে আসছে।

এই অদৃষ্টপূর্ব পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের হাতে একটাই অস্ত্র আছে: সংযম। যদিও সেটার ব্যবহার চোখে পড়ছে সামান্যই। বরং শঠে শাঠ্যং করতে গিয়ে উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজন যদি তর্কের উত্তেজনায় বা দেশোদ্ধারের তাড়নায় কাণ্ডজ্ঞান এবং শিষ্টতাবোধ জলাঞ্জলি দেন, তাতে এক দিকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সুবিধে হয়, দুষ্কর্ম আরও অক্সিজেন পায়। অন্য দিকে, নিতান্ত সাধারণ মানুষ আরও ঘাবড়ে যান, বীতশ্রদ্ধ বোধ করেন। যে শুভচেতনা ছড়ানোর জন্য এত বাগ্‌যুদ্ধ, এত তথ্যভাণ্ডারের আবাহন, বহুলাংশে তা ব্যুমেরাং হয়ে অসহিষ্ণুতার হাতই শক্ত করে।

আসলে মুশকিল হল, আমাদের নিজেদের কাছেই পরিষ্কার নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালটি আমাদের ব্যক্তিগত বৈঠকখানা না কি ধর্মতলার মোড়। সকালে কত বার হাই তুলেছি থেকে শুরু করে ট্রাম্প জিতে কী সর্বনাশ হল গো, সবই সমান তালে শেয়ার করে যাচ্ছি। তার সঙ্গে অজস্র লিংক, মিম আর ক্লিপিং, দেখামাত্র ছড়িয়ে দিচ্ছি। তার মধ্যে আইএস-এর গলা কাটাও আছে, গরু-গুন্ডাদের তাণ্ডবও আছে। অজস্র জানা-না জানা, ভুয়ো এবং খাঁটি খবরাখবর, মিটিং-মিছিলের দৃশ্য-স্লোগান-ধারাবিবরণী, ইতিহাস-ব্যঙ্গচিত্র— এ পাড়ায় কিছুই ব্রাত্য নয়। সেই সঙ্গে মুখের, থুড়ি আঙুলের আগল গেছে খুলে। পরিচিত-অপরিচিত-স্বল্প পরিচিত মানুষের বাহবায় গলে পড়তে সময় নিচ্ছি না। আবার কোনও কথা আপত্তিকর মনে হলেই তেড়ে গালাগাল করতেও দু’বার ভাবছি না। যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে খিস্তিখেউড় এত প্রকাশ্য, এত অবাধ করে ফেলেছি, সেটা কোন সহিষ্ণুতার পরিচয়, নিজেদের শুধিয়েছি কি? বিপ্রতীপ মতের মানুষ দেখলেই নিজেরা ‘রে রে’ করে উঠব আর আশা করব সমাজে বহুত্ববাদের জোয়ার আসবে, তা-ই কি হয়? আমি যদি কাউকে গাল দিই, তা হলে সেটা আমার ব্যক্তিগত মত প্রকাশের অধিকার, আমি যদি ট্রোলড হই, তা হলে সেটা অশিষ্টাচার— সুবিধাবাদী অবস্থান নয়? গালির উত্তরে গালি না দিয়ে, ভিডিয়োর উত্তরে পাল্টা ভিডিয়ো না পোস্ট করে, দেশ উচ্ছন্নে গেল বলে হাহুতাশ না ছড়িয়ে একটু সংযত, একটু সুস্থিত, একটু শান্ত থাকা যায় না?

প্রশ্ন হল, আমি-আপনি বাক্‌সংযম করলেই কি সমস্যা মিটে যাবে? যাবে না হয়তো। কিন্তু বিপদ কমাতে না পারি, না-বাড়ানোর চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। আপনার দেওয়ালে আপনি কী লিখবেন, সেটা নিশ্চয় আপনার স্বাধীনতা। স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ না করেও আত্মনিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেটাই সংযম, সেটাই দায়িত্বশীল আচরণ। সোশ্যাল মিডিয়ার আচরণবিধি কী হওয়া উচিত, সেটাও কিন্তু এখনও স্পষ্ট নয়। অতএব স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে এবং একটু তলিয়ে ভেবে কথা বলাই বাঞ্ছনীয়। এই বহুধাবিভক্ত সমাজে কোন কথা কোথায় কী ভাবে পৌঁছবে, কোন কথায় কার মনে কী প্রতিক্রিয়া জন্ম নেবে, সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনি হয়তো খুবই সদুদ্দেশ্যে কোনও লিংক শেয়ার করেছেন। জনসচেতনতা বাড়ানোর কথা ভেবেছেন। কিন্তু কী করে বুঝবেন, সেটা অন্য কারও চোয়াল শক্ত করে তুলছে না? কোনও জায়গায় অশান্তির খবর এসেছে শুনে আপনি হয়তো উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। সেটা যে কারও মনে প্রতিহিংসার আগুন উসকে দিল না, কী করে জানবেন? তার চেয়ে ভাল নয় কি, প্রকাশ্য দেওয়ালে কিছু লেখা বা শেয়ার করার আগে দশ দিক একটু ভেবে নেওয়া? তাতে নিজের সমাজচেতনার বিজ্ঞাপন যদি ক’দিন একটু কম হয়, খুব ক্ষতি হবে? হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিয়ো পাঠাল কেউ। উত্তেজনার বশে তৎক্ষণাৎ শেয়ার না-ই বা করলেন! আপনি হয়তো চেনাজানা ক’জনকেই পাঠাচ্ছেন। কিন্তু প্রাপকরা যে একই রকম দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবেন, তার নিশ্চয়তা কী? তার থেকে আপনিই না-হয় আগেভাগে সংযত হলেন! সোশ্যাল মিডিয়া তো শুধু একক প্রোফাইল নিয়েও চলে না। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে অজস্র গ্রুপ আছে। যেগুলো ছোটবড় গোষ্ঠী হিসেবে সক্রিয়। অস্থির সময়ে এই ভার্চুয়াল গ্রুপই বাস্তবের ‘মব’ হয়ে উঠছে বহু ক্ষেত্রে। সুতরাং মনে রাখতে হবে, আপনার একটা শেয়ার, একটা পোস্ট ঝটিতি একটা মব-কে উসকে দিতে পারে।

মব কিন্তু মানবসম্পদ নয়, মূর্তিমান বি‌ভীষিকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE