ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, টিউনিসিয়ার পর এ বার ইয়েমেন। পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে যাহা চলিয়াছে, তাহা স্পষ্টতই গৃহযুদ্ধ। কোথাও কোনও বাহিরের শক্তি সেই যুদ্ধ পরিচালনা করিতেছে না, যদিও ইরাক ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ইরানের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তবে এই দুই দেশের ক্ষেত্রেও ইরান অনেক পরে মাথা গলাইয়াছে, প্রধানত শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে শিয়াদের সমর্থন করিতে এবং সেই প্রক্রিয়ায় এলাকায় সৌদি আরবের বিপরীতে নিজ প্রভাবের অক্ষ বিস্তৃত করিতে। মিশরও সামরিক স্বৈরাচার বনাম রাজনৈতিক ইসলামের দ্বন্দ্বে গৃহযুদ্ধের দিকেই ক্রমশ অগ্রসর হইতেছিল। কেবল সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়া গণতন্ত্রের মাধ্যমে উদীয়মান মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতাচ্যুত করায় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা হইতে শেষ মুহূর্তে দেশ বাঁচিয়া যায়। অবশিষ্ট মুসলিম দেশগুলিতে যেখানেই আরব বসন্তের বায়ু প্রবাহিত হয়, সেখানেই গণতন্ত্রের পথ ধরিয়া নৈরাজ্য ও গৃহযুদ্ধ ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
উপাদানগুলি এই সব দেশের অভ্যন্তরেই মজুত ছিল। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রেই শাসনক্ষমতা স্বৈরশাসকের হস্তে কেন্দ্রীভূত থাকায় বিবিধ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসিতে পারে নাই। ইরাক ও লিবিয়ায় সাদ্দাম হুসেন ও মোয়াম্মার গদ্দাফির স্বৈরাচারী শাসন বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠী ও জনজাতির দ্বন্দ্বকে চাপা দিয়া রাখিয়াছিল। সিরিয়াতেও বাশার-আল-আসাদের স্বৈরাচার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরোধকে গৃহযুদ্ধে বিস্ফোরিত হইতে দেয় নাই। কিন্তু বাদ সাধিল মার্কিন ও ইউরোপীয় গণতন্ত্রীদের পশ্চিম এশিয়ায় ‘স্বৈরাচার উৎখাত’-এর প্রকল্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের অনুরূপ প্রকল্প ইরাক হইতে সাদ্দাম হুসেনের জমানার অবসান ঘটাইতে দফায় দফায় এক অসম যুদ্ধ মারফত সেই দেশের সামাজিক ভারসাম্য এমন ভাবে বিনষ্ট করিয়া দেয় যে, ইরাক বরাবরের জন্য শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষের উর্বর জমি হইয়া ওঠে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট তো স্বীকারই করিয়াছেন, ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্রবাদী খিলাফতের উত্থানের পিছনে দায়ী সাদ্দাম হুসেনের অপসারণ। সিরিয়াতেও আসাদের হাত হইতে ‘সিরীয় গণতন্ত্র’কে বাঁচাইতে পাশ্চাত্যের তরফে বিদ্রোহী জঙ্গিদের সমর্থন এবং অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ গৃহযুদ্ধকে মীমাংসার অতীত করিয়াছে। লিবিয়ায় যত দিন গদ্দাফি ক্ষমতাসীন ছিলেন, তত দিন সেখানে এত রকমের মুজাহিদ ও মিলিশিয়ার দেখা মেলে নাই। আফগানিস্তানের মুজাহিদিন ও তালিবানরাও সেখানে রুশ আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণাম। ইয়েমেনে যে ভাবে এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্য দিকে সৌদি শাসকরা হস্তক্ষেপ করিয়াছে, তাহার পরিণামেই সেই দেশ আবার দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মুখে।
ইসলামি বিশ্বের সমাজের একটি বড় অংশের সামনে পশ্চিমী গণতন্ত্র বরাবরই দুশমন রূপে চিহ্নিত। পশ্চিমী সভ্যতার অবক্ষয়ী প্রভাব মুসলিম সমাজ ও জীবনচর্যাকে বিকৃত, অধঃপতিত করিতেছে, এই বিশ্বাস হইতে গোঁড়া মুসলমানরা পাশ্চাত্য ও তাহার মূল ঘাঁটি আমেরিকাকে আক্রমণের লক্ষ্য বানাইয়াছেন। সেই পশ্চিমী গণতন্ত্র আবার মুসলিম দেশগুলির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া সেই শত্রুতা আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছে। এখন পরিস্থিতি এক অস্বাভাবিক এবং, আক্ষরিক অর্থেই, অভূতপূর্ব জটিলতা অর্জন করিয়াছে। বাহিরের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই ভয়াবহ অবস্থা সামাল দেওয়া কঠিন, আবার ইহাও অনস্বীকার্য যে বাহিরের হস্তক্ষেপ নূতন সমস্যা সৃষ্টি করিতে পারে। বারাক ওবামা এবং তাঁহার ইউরোপীয় ও পশ্চিম এশীয় সমর্থক-সঙ্গীদের উভয়সংকট মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান শর্ত: এই ভূখণ্ডের দেশগুলিকে আধিপত্য বিস্তারের উপকরণ হিসাবে দেখিবার অভ্যাস বিসর্জন দেওয়া। কঠিন শর্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy