Advertisement
E-Paper

অশ্রু হইতে সাবধান

শুধু কয়েকটা ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিয়ে এই দেশের সম্ভ্রান্ত যৌন শালীনতাকে তাই ধ্বস্ত করা যাবে না। লুয়াক মট্টিঘরম তাঁর বইয়ে স্পষ্ট প্রমাণ করেছেন, শিবলিঙ্গ মানে মোটেই শিবের লিঙ্গ নয়, বুড়ো আঙুল।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৭ ১০:০০

এক বিরাট মাপের মানুষ যখন বলেন ময়ূর আজীবন ব্রহ্মচারী এবং তার অশ্রু দ্বারা ময়ূরীর গর্ভসঞ্চার হয়, তখন তাঁর কথাটাকে বুঝতে হবে অক্ষর দিয়ে নয়, দ্যোতনা দিয়ে। ময়ূর সত্যিই যৌনতা করে কি না, তা বড় নয়। বড় কথা হল, ভারতের জাতীয় পাখি হতে গেলে (বা যে কোনও তুঙ্গ আইকন হতে গেলে), অযৌন হতে হবে। কারণ, ভারতীয়তা মানে যৌনতাহীনতা। বায়োলজিগত ভাবেও কথাটা ভুল নয়। ভারতের গরু, সজারু, দুর্গাটুনটুনি, গঙ্গাফড়িং, শিঙিমাছ ও উদবেড়াল কখনওই যৌনতা করে না। সারা জীবনে মাত্র তিন কি চার বার যৌনতা করে শুঁয়োপোকা, বালিহাঁস, তেঁতুলে বিছে ও বাঙালি গেরস্থ। বছরে এক বারের বেশি যৌনতা করা সম্পূর্ণ বারণ দৌরোয়া, ভীল, নেকুয়া ও মান্তু জনজাতিতে। শুধু কয়েকটা ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিয়ে এই দেশের সম্ভ্রান্ত যৌন শালীনতাকে তাই ধ্বস্ত করা যাবে না। লুয়াক মট্টিঘরম তাঁর বইয়ে স্পষ্ট প্রমাণ করেছেন, শিবলিঙ্গ মানে মোটেই শিবের লিঙ্গ নয়, বুড়ো আঙুল। ঘঘর পট্টনায়ক দেখিয়েছেন, খাজুরাহোর সমস্ত আসন আসলে যোগাসন, কো-এড কলেজের ক্লাসগুলির অনুসরণে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে বলে অমন দেখাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, উদবেড়াল তবে বংশবৃদ্ধি করে কী করে। এই জিজ্ঞাসা উসকে দেওয়াটাই আসল ব্যাপার। ভারত যেমন পৃথিবীকে বিকল্প চিকিৎসার সন্ধান দিয়েছে (দিনে ছ’ঘণ্টা কপালভাতি করলেই এডস সেরে যায়), বিকল্প অর্থনীতির খোঁজ দিয়েছে (মানুষকে এটিএমের লাইনে দাঁড় করিয়ে দগ্ধে মারলেই দুর্নীতি কমে আসে), তেমনই বিকল্প প্রজনন-প্রক্রিয়ারও হদিশ দিচ্ছে। সারা বিশ্বে আমেরিকা প্রচার করে দিয়েছে, সন্তান লাভের জন্য তথাকথিত যৌনাঙ্গের ব্যবহার প্রয়োজন। কে বলল? উদবেড়াল শুধু উদবেড়ালির দিকে তাকিয়ে বাঁ কনুইটা এক বার ৩৬ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে নাড়ায়। শিঙিমাছ শুধু ডিঙি মেরে শিঙিনির চার পাশে মশারি টাঙিয়ে দেয়। পাশ্চাত্যের কিছু দেশ মিলে প্রাচ্যের যুবসমাজকে দুর্বল করার জন্য পরিকল্পিত ভাবে যৌন সুখের যে ঘিনঘিনে সংস্কৃতি চালু করতে চাইছে বহু দশক ধরে, নাগাড়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে যে বাচ্চা উৎপাদন করতে গেলে মানুষকে এক নির্দিষ্ট অশ্লীল প্রক্রিয়ায় মিলিত হতে হয়, এবং আমাদের দেশের নিরীহ অসন্দিহান লোকেরা বাচ্চা চাইতে গিয়ে শেষে এই স্থূল গদগদে আরামের সম্মোহনে পড়ে বহু কাজের মুহূর্ত কু-খরচা করছে, সে চক্রান্তকে আলোয় আনাই বিচারপতির মন্তব্যের মূল ফোকাস। আমাদের স্যান্‌স্ক্রিট পড়েশুনে জানতে হবে, সন্তান উৎপাদনের উপায় কত বিচিত্র রকম, তার পর সর্বাধিক অপাপবিদ্ধ পদ্ধতিটি ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃত ভারতীয় হতে গেলে, পাকিস্তানকে ঘৃণা করার মতোই, না ছুঁয়ে যৌনতা প্র্যাকটিস আশু কর্তব্য।

আরও খবর
যুক্তি-তর্কের পরিসরটাকেই ক্রমশ সঙ্কুচিত করে আনছেন এঁরা

গাঢ় সার হল, একটা জাতি মহৎ হয়ে উঠতে পারে তখনই, যখন সে তার শিকড়ের সন্ধানে ডাইভ মারে। আজ বিজেপি-র উত্থানের ফলে যে ভারতে সর্ব স্তরে নিজ প্রাচীন সম্পদগুলি খনন করা হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে, আমাদের অন্য দেশ ও সভ্যতার কাছ থেকে কিচ্ছু শেখার দরকার নেই, মোবাইল বা মিসাইল এখানে মহাভারতের যুগ থেকেই ছিল, চ্যবন ঋষি জিন্‌সের কৌপীন পরতেন এবং দধীচী জেট প্লেনে চেপে বাজার করতে যেতেন— এ এক বিরল সৌভাগ্যের যুগসূচনা। বোমকে দেওয়া তথ্য ও সত্য জানতে আমাদের কঠ, হ্রীংক্লীং, ঋক, সাম পড়ে অসাম বলতে হবে। তখন জানতে পারব, পূর্বজন্মে প্রজাকে শোষণ করলে পরজন্মে লজেন্স হয়ে জন্মাতে হয়। কিংবা, ময়ূর দাঁতব্যথায় হাউহাউ কেঁদে ফেললে ময়ূরীর ষোলোটা বাচ্চা হয়ে যায়।

অশ্রুর মাহাত্ম্য ও গুরুত্বও এ ভাবে কখনও মেনস্ট্রিমে আসেনি। বাড়ির মা-বোনকে লাগাতার শরৎচন্দ্র পড়িয়ে তাঁদের কান্নার তোড়-কে হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রোজেক্টে ব্যবহারের পরামর্শ বহু আগেই দিয়েছিলেন জয়বিজয় ত্রিবেদী, কিন্তু তা নিতান্ত ব্যবহারিক উপযোগিতার আলোচনা। জাতীয় প্রতীকের শৌর্য বীর্য অশ্রুর ধর্ম তো আমাদের ঘাড়েও অবধারিত হুমড়ি খায়। কোনও ছেলে কোনও মেয়েকে দেখে অশ্রুপাত শুরু করা মানে যে আসলে সে মেয়েটির গর্ভে সন্তানোৎপাদন করতে চায়, ফ্রয়েড বা ইয়ুং তাড়া তাড়া নোটে এর টিকিও তাড়া করতে পেরেছিলেন? এই এক্সট্রা তাৎপর্য এত দিন আমাদের অজানা ছিল বলে কত শিল্পে, সর্বোপরি কত বাস্তব পরিস্থিতিতে সহস্র ইঙ্গিত ও অবচেতন অভিপ্রায় বুঝতে পারিনি। এমনকী নিজেও যখন প্রেমিকাকে বলেছি ‘প্লিজ ছেড়ে যেয়ো না, ফোঁৎ ফোঁৎ’, আসলে যে বলছিলাম, ‘এসো তোমাকে প্রেগন্যান্ট করে দিই, তা হলেই বাঁধা পড়ে যাবে’, সে চক্রান্তমূলক বিষাদকে চিনতে পেরে এখন নিজেকে নতুন করে হীন বলে জানছি। ইভ-টিজিংকেও পূর্ণ ভুল দৃষ্টিতে দেখি আমরা। রাস্তায় একটি মেয়েকে কদর্য টোন কাটা বা হাত ধরে টানা, এমনকী তার কাপড় খুলে দেওয়াও ততটা অসভ্য কর্ম নয়, যতটা, তুরন্ত কেঁদে ফেলে মুখ ঝাঁকিয়ে তার দিকে চোখের জল ছুড়ে মারা। মাথার ঘাম টিপ করে পায়ে ফেলে যেমন শ্রমিককে তার কর্মগরিমা বোঝাতে হয়, এ বার থেকে অশ্রু টিপ করে মেয়েদের দিকে ছুড়ছে দেখলে লোফারের অপ-ক্যালিবার বোঝা যাবে। এবং অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড তাকে খপাৎ ধরবে। পেটাবার সময় মহিলা পুলিশ আবার কাছাকাছি না থাকে। ছেলেটা মার খেয়ে হাঁউমাউ কাঁদবে তো, যদি ফট করে চোখের জল ছিটকে যায়!

(এ লেখার সব তথ্যই মিথ্যে, কিন্তু তা হয়তো ঘি ঢালছে ভাবী বিচারপতিত্বে!)

Peacock Judge Comment Controversy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy