অন্যের থেকে দূরে থাকুন, ছ’ফুট দূরে। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। বাড়ি থেকে কাজ করুন। করোনাভাইরাস এড়াতে কী কী করতে হয়, শুনলেন? এ বার ভাবুন, আপনি ভারতের চল্লিশ লক্ষ পথবাসী, কিংবা সাত কোটি ঝুপড়িবাসীর একজন। আপনার মতো পঞ্চাশ-ষাট মানুষের জন্য একটা পূতিগন্ধময় শৌচাগার, গোটা পঁয়তাল্লিশ কলসি-বালতি টপকে পৌঁছতে হয় জলের কলে। আটশো স্কোয়ার ফুটে আপনার ঝুপড়ির সঙ্গে আরও চার-পাঁচটা ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে। এ বার বলুন, কী করে বাঁচবেন? বাঁচাবেন অন্যকে?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে প্রবল প্রচার চলছে, তার মধ্যে এই সত্যটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেন দূরে সরে থাকা, ঘরবন্দি থাকা, পরিচ্ছন্ন থাকা, কেবল ইচ্ছের অপেক্ষা। বার বার বলা হচ্ছে, ঝুঁকি প্রধানত বৃদ্ধ আর ডায়াবিটিস প্রভৃতি অসুখে আক্রান্তদের। অথচ চিন এবং ইউরোপে মহামারির গতিবিধি লক্ষ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রয়েছে তৃতীয় একটি ঝুঁকি — দারিদ্র। দরিদ্রের পক্ষে সংক্রমণ এড়ানোর নির্দেশ মানা প্রায় অসম্ভব। চিন আর হংকং-এর আবাসনের কী দুর্দশা। একটা ফ্ল্যাটে এক-একটা ঘরে এক-একটি পরিবারের বাস, তিন-চারটি পরিবারের জন্য একটা কিচেন, একটা বাথরুম। সেখানে ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ কতটা সম্ভব, প্রশ্ন উঠছে।
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ শহরে বসবাসে এমন গায়ে-গায়ে, হাওয়া চলাচল কিংবা নিকাশির ব্যবস্থা এতই মন্দ, যে ঘরবন্দি থাকাও নিরাপদ নয়। দিল্লির বস্তিগুলো শহরে ফ্লু-এর প্রকোপ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আজ কলকাতার অনেক গৃহপরিচারিকা সবেতন ছুটি পেলেও কাজে আসতে চান, কাজের বাড়িতে জলের সহজলভ্যতার জন্য।
গরিবকে ঝুঁকি বাড়ে রোজগারের তাগিদে। ইতালির এক ট্যাক্সিচালক সাংবাদিককে বলেছেন, ‘‘বিল মেটাতে হবে, বাড়ির ঋণের কিস্তি দিতে হবে, খাবার কিনতে হবে দুই সন্তানের জন্য। কী করে বাড়ি বসে থাকব?’’ ভারতে এমন মানুষের সংখ্যাটা আন্দাজ করা কঠিন। গত কয়েক বছরে দক্ষ এবং অদক্ষ, দুই ধরনের শ্রমিকের কাজই ক্রমাগত ঠিকাদারের অধীনে চলে গিয়েছে। ঠিকাদারেরা শ্রমিকদের নথিভুক্তি করেন না, তাই তাদের একটি বড় অংশই অদৃশ্য। এই শ্রমিকরাই ভিনরাজ্যে শহর নোংরা করায় অভিযুক্ত হয়, তাদের স্ত্রীরা বাড়ি পরিষ্কার করায় নিযুক্ত হয়। আজ এঁরা কাজ হারিয়ে ফিরে আসছেন। কী করে নিজে নিরাপদ থাকবেন, অন্যকে রাখবেন, কতটা জেনেছেন-বুঝেছেন?
মজুরের কাজের নিরাপত্তা না থাকা নাকি শিল্পের জন্য ভাল। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভয়ানক ছোঁয়াচে ‘নোরোভাইরাস’ ছড়ানোর অন্যতম কারণ, ডায়ারিয়ায় ভুগেও রেস্তোরাঁ কর্মীদের পাঁচ জনের এক জন কাজে আসেন, পাছে না এলে কাজ চলে যায়। ফ্লু হলে ছুটি নিতেই হবে, এই নীতির জন্য মার্কিন দেশে ফ্লু-এর বিস্তার চল্লিশ শতাংশ কমেছে। অধিকাংশ দেশে এমন বিধি নেই। ছুটি চাইলে ছাঁটাই, এই অমানবিক নিয়মের জন্য গরিব নিজে বিপন্ন হয়, অজান্তে অন্যকেও বিপন্ন করে।
তবে কেবল অতি-দরিদ্রই নয়, নিম্নবিত্ত, স্বল্পবিত্ত মানুষদেরও একটা বড় অংশ এমন পেশার সঙ্গে যুক্ত যেখানে পরিষেবা দিতে, পণ্য বিক্রি করতে গেলে অন্য মানুষের সংস্পর্শে তাঁকে আসতেই হবে। এঁদের কেউ কেউ দু-এক সপ্তাহ টেনেটুনে চালাতে পারবেন, কেউ দু-তিন মাস। তার পর টান পড়বে সঞ্চয়ে, কাজের পুঁজিতে। ছোটখাটো উৎপাদনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা আবার অন্যদের কাজ দেন। তাঁদেরও রোজগার বন্ধ হবে। মহামারির বিস্তার রোধ না হলে দারিদ্রসীমার নীচে তলিয়ে যাবেন অগণিত মানুষ।
রোগ আর দারিদ্রের এক দুষ্টচক্র রয়েছে। অপুষ্টির জন্য বেশি রোগ, রোগের জন্য দারিদ্র, দারিদ্রের জন্য অপুষ্টি, এমন চলতে থাকে। মহামারির মোকাবিলার সময়ে সেটা কি ভাবা হয়? স্কুল বন্ধ, তাই এ রাজ্যে মিড ডে মিলের ভাত-ডাল, সয়াবিন, তরকারি, ডিম রাতারাতি পরিণত হল স্রেফ চাল-আলুতে। বেশি দিন এমন চললে শিশুদের পুষ্টি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উপর কী প্রভাব পড়বে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধনী পরিবারে সত্তরোর্ধ্ব মানুষের যে ঝুঁকি করোনাভাইরাস থেকে, মন্দ স্বাস্থ্যের কারণে ৫৫ বছরেই সেই ঝুঁকি দরিদ্রের।
বিত্তবান মানুষ দরিদ্রের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিজের নিরাপত্তা ও কৌলীন্য বজায় রাখতে চায়। কিন্তু নানা রোগজীবাণু বার বার মহামারির আকারে এসে মনে করিয়েছে, ঝাঁ চকচকে টাউনশিপ তৈরি করে গেটে দারোয়ান বসিয়ে নিরাপত্তা মেলে না।
আপাতত চাষি-মজুরের জন্য যা বাস্তবসম্মত, তেমন নির্দেশ পৌঁছে দিক সরকার। যে পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরেছে, যারা আটকে আছে ভিনরাজ্যে, তারা কী করবে? প্লাস্টিকে তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে ভাইরাস। তবে কি মুদির দোকান প্লাস্টিকের ব্যাগ বন্ধ করবে? কার্ডবোর্ডে বাঁচে ২৪ ঘণ্টা, তা হলে কী করে বিপদ এড়াবেন অনলাইন শপিং ডেলিভারি কর্মী? ব্যবসায়ী-মজুর, ট্রাক লোড-করা লেবার, রেশন দোকান বা পেট্রল পাম্পের কর্মী, খনি-খাদানের মজুর, বস্তি-ফুটপাথবাসী, কাজ অনুসারে ঝুঁকি বদলে যায় তাঁদের, তাই স্বাস্থ্যের নির্দেশও বদলানো চাই। আর প্রচার চাই এমন, যাতে নিরাপত্তার বার্তা পৌঁছয় তাঁদের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy